ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চাই প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ

মহসীন কবির লিমন
🕐 ৮:৪৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০১৮

জন্মের পর থেকেই প্রতিদিনই আমাদের বয়স বাড়ছে। শৈশব কৈশোর যৌবন পেরিয়ে একসময় আমরা পৌঁছে যাই প্রবীণ বয়সে।

প্রবীণ বয়সটা আসলে কেমন। আমরা যারা তরুণ রয়েছি আমাদের ধারণাই নেই সেই বয়সটিতে আমিই-বা কেমন থাকব। প্রবীণ জীবন আসলে সুখের নয়। বাংলাদেশে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদেরই আমরা প্রবীণ ব্যক্তি বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করব। কেমন আছেন আমাদের দেশের বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা। আমি বলব ভালো নেই। আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশ। এখনো এই দেশের অনেক মানুষই তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায় না।
জীবন-জীবিকার লড়াইটা করতে হয় বেশিরভাগ মানুষকেই। জন্মের পর থেকেই শুরু হয় একটু ভালোভাবে বাঁচবার জন্য জীবনের দৌড়। কিন্তু এই দৌড়ের শেষ কোথায়? কোথায় এর পরিসমাপ্তি? মৃত্যুর আগে সেই দৌড়টা যে আরও বেশি করে দিতে হবে। পারবেন তো, আমরা প্রস্তুত তো? একটা সময় চাইলেও কি আমরা পারব যৌবনের মতো দৌড়াতে। না, পারব না।
বার্ধক্য এসে ভর করবে আমাদের শরীরে। মানুষের মন কখনো বুড়ো হয় না কিন্তু সব শক্তি খেয়ে নিয়ে শরীর একটু একটু করে বুড়ো হয়ে যায়। চিরচেনা নিজের সেই শরীরকে আরেকটু সুস্থ সবলভাবে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন পড়ে খাবারের, প্রয়োজন পড়ে চিকিৎসার, প্রয়োজন পড়ে অর্থের।
বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু। বাড়ছে এদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বলছে, যদি আকস্মিক মৃত্যু না ঘটে আপনি চাইলেও আর ৭৩ বছরের আগে মরছেন না। কারণ গড় আয়ুটা যে বেড়ে গেছে। আবার রাষ্ট্রই বলছে আপনার বয়স ৬০ বছর হলেই আপনি প্রবীণ, আপনার কোনো কর্মসংস্থান নেই।
অন্যদিকে সমাজ ব্যবস্থায় যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে তৈরি হচ্ছে একক পরিবার। এই একক পরিবারের ফলে পরিবারে বাড়ছে প্রবীণের নিরাপত্তাহীনতা। প্রবীণরা পালাবে কোথায়? রাষ্ট্র পরিবার সমাজ কেউই প্রবীণদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা নেহাতই কম নয়, এই মুহূর্তে জনসংখ্যার ৮ শতাংশ প্রবীণ, আর তা প্রায় দেড় কোটি। হিসাব বলছে, প্রবীণ বৃদ্ধির এই হার যদি অব্যাহত থাকে তবে ২০২৫ সাল নাগাদ এদেশে প্রবীণের সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজনে ১ জন প্রবীণ থাকবে।
হিসাবটা জানা দরকার, কারণ এই ২০১৮ সালে এসেও প্রবীণদের নিরাপত্তায় এখন পর্যন্ত আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, ২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন পাস হয়েছে, ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতি এদেশের প্রবীণদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করে কিছু সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন। কিন্তু, কথাগুলো যেন কথাই থেকে যায়। বাস্তবে আমরা প্রবীণদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেখতে পাই না। বরং দিনকে দিন বাড়ছে প্রবীণ নির্যাতন।
প্রবীণরা নির্যাতিত হচ্ছেন ঘরে, সমাজে তথা রাষ্ট্রে। আমাদের ঘর, সমাজ ও রাষ্ট্র খুব বেশি প্রবীণবান্ধব নয়। গবেষণা বলছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রবীণরা তিন ধরনের নির্যাতনের শিকারÑ শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন। পুরুষের চেয়ে মহিলারা এই নির্যাতনের শিকার বেশি হন। শহুরে প্রবীণরা তবুও পরিবারে কোনো রকম টিকে থাকলেও গ্রামীণ প্রবীণদের চিত্রটা আরও ভয়াবহ।
যে ব্যক্তি সারা জীবন কৃষিকাজ করতেন বা কঠোর পরিশ্রমের কাজ করে আয় রোজগার করতেস তিনি প্রবীণ বয়সে আর ভারী কাজ করতে পারছেন না, অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও আয় রোজগারের আশায় শহরমুখী। তারাও তাদের বাবা-মাকে ঠিকমতো দেখভাল করতে পারে না। এতে করে গ্রামীণ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ছিটকে যাচ্ছে সমাজ থেকে। বেঁচে থাকার জন্য তারাও শহরমুখী হচ্ছেন, বেছে নিচ্ছেন ভিক্ষাবৃত্তি।
বাড়ছে ছিন্নমূল প্রবীণের সংখ্যা, পথপ্রবীণের সংখ্যা। শহরের চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন হলেও প্রবীণরা নিজ বাড়িতেই অনেক সময় দুর্ভোগের শিকার হন। নিজের ইচ্ছের কথাগুলো তারা ছেলেমেয়েদের বলতে পারছেন না, ছেলেমেয়েরা তাদের সম্পত্তি লিখে নিচ্ছে এবং তারপর তাদের আর খোঁজখবর রাখছে না। তারা ভুগছেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়। অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে তারা বঞ্চিত।
ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় অনেক প্রবীণই মনে মনে আলাদা থাকতে চান কিন্তু কে নেবে তাদের দায়িত্ব। আবার অনেক প্রবীণই পেনশনের টাকা বা তার নিজ জমানো টাকা দিয়ে নিজের মতো বাস করতে চান। সেক্ষেত্রে তারা খুঁজে বেড়ান বাসযোগ্য একটি জায়গা। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এখনো প্রবীণদের জন্য বাসযোগ্য ‘প্রবীণ নিবাস’ তৈরি হয়নি। এটি হওয়া জরুরি।
প্রবীণরা চাইলেও আলাদা করে বসবাস করতে পারছেন না। প্রবীণদের জন্য নেই কোনো আলাদা অধিকারের ব্যবস্থা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন পর্যন্ত নেই কোনো জেরিয়েট্রিক মেডিসিন স্পেশালিস্ট, নেই জেরিয়েট্রিক মেডিসিন বিভাগ, স¦ল্পমূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা। ট্রেন, বাস কিংবা কোনো লাইনে প্রবীণদের জন্য নেই কোনো আলাদা অগ্রাধিকার। নেই সামাজিক ব্যবস্থায় তাদের জন্য তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।
প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ভুগে থাকেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সক্ষম প্রবীণদের তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি পরিবারে প্রবীণের ¯^স্তিময় বাস নিশ্চিত করতে হবে। সমাজ ব্যবস্থায় প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট প্রবীণ দরদী।
তার হাত ধরেই চালু হয়েছে বয়স্কভাতা কর্মসূচি। প্রবীণ দরদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায়ই এদেশে প্রবীণদের স্বস্তিময় বার্ধক্য নিশ্চিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা চাই প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ। আমাদের নবীন ও তরুণ জনগোষ্ঠীকেও প্রবীণকল্যাণে আজ থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে আজকের নবীনই কিন্তু আগামী দিনের প্রবীণ। আমরা আজ প্রবীণদের জন্য প্রাপ্য সম্মান ও ¯^স্তিময় বার্ধক্য নিশ্চিত করতে পারলে আগামীকাল আমরা যখন প্রবীণ হব তখন সেই সুফল আমরাই ভোগ করব। আসুন সবাই মিলে প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আজ থেকেই কাজ শুরু করি। বোঝা নয় বরং প্রবীণ হোক আমাদের অহংকার।

মহসীন কবির লিমন :
প্রতিষ্ঠাতা, প্রবীণ বন্ধু ফাউন্ডেশন (প্রবফা)

 

 

 
Electronic Paper