ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আনন্দহীন লক্ষ বেকারের ঈদ!

ইমরান মাহফুজ
🕐 ৯:০০ অপরাহ্ণ, জুন ১৩, ২০১৮

মন খারাপ। সামনে ঈদ, যাদের চাকরি নেই, তারা কেমন আছেন? তাদের উৎসবগুলো কেমন, তা ভেবে একজন তরুণ হিসেবে ভালো লাগছে না। এইভাবে দেশ চলতে পারে না। কারণ দীর্ঘদিন থেকে শত শত উচ্চ শিক্ষার্থী হতাশগ্রস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।

দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবন যাপন করছেন এবং সেটা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে বলছে- ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ দুই বছরে মাত্র ছয় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অথচ এই সময়ে দেশের কর্ম বাজারে প্রবেশ করেছেন প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ। অথচ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর চাকরি বা কাজ পেয়েছেন ১৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০১৬)।
এখন অনেকে বলছেন বেকারত্ব এক অভিশাপ! প্রসঙ্গে বেশকিছু বিষয় ভাবলাম এবং মাঠে গিয়ে কথা বললাম, ঢাবি, জাবি, জবি, শাস্ট, ইডেন কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে, অধিকাংশরই স্বপ্ন বিসিএস। ব্যতিক্রম দেখেছি ব্র্যাক ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে, তারা নিজে কিছু করতে চায়। তার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু শাস্ট- শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও প্রযুক্তির কাজে আগ্রহী না হয়ে চাকরি করতে চায়। কেন?
জানতে চাইলে একজন বললেন, সরকারি চাকরিতে একটা সম্মান আছে। আবার বিয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায় সরকারি চাকরি বেশি গুরুত্ব পায়। বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসের চাকরি এখন বেশ লোভনীয়। প্রতিযোগিতাও বেড়ে গেছে মারাত্মক।
সাধারণ শিক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে পাস করা ছাড়াও এখন বিবিএ, আইবিএ, বুয়েট থেকে বেরিয়েও আগ্রহী সরকারি কর্মকমিশনে!
সেই সঙ্গে একদল শিক্ষিত বেকার দাবি তুলেছেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর করতে হবে। খুব হাস্যকর! পথ নিয়ে ভাবে না, পথের মানুষ নিয়ে মাথাব্যথা। চিন্তার কত সংকট।
আবার দেখা যায় আমাদের দেশের দুই ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রথমে তারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যতটা আগ্রহী, কারিগরি বা কর্মদক্ষতা বাড়ানোর শিক্ষা নিতে ততটা আগ্রহী নন।
দ্বিতীয়ত খুব কম ক্ষেত্রেই কাউকে উদ্যোক্তা হতে দেখা যায়। সবাই চাকরি প্রত্যাশা করেন, কেউ চাকরি সৃষ্টির কথা ভাবেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরির আশায় দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা এখন সাধারণ বিষয়।
এছাড়াও বর্তমানে সময়ে সবকিছুতেই প্রবেশাধিকার অনেক বেশি। আমরা অন্যদের জীবন যাপন দেখে নিজের জন্যও অনেক সময় সে রকম জীবনের চিন্তা করি। আর সেটা হয়তো অর্থনৈতিক কারণে কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কারণে যখন পান না তখনই হতাশায় থাকেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনো কিছু হচ্ছে না তখনই তারা হতাশায় ভোগেন। এদেশে ঘুষ, দুর্নীতি কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন। অযোগ্য মানুষরা দলীয় আনুগত্যের কারণে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর এই দৌড়ে তরুণ মেধাবীরা মার খেয়ে যাচ্ছেন। তবে কাজ জানা লোক কোনোদিন বেকার থাকছেন না, কিংবা আমাদের দেশের ‘উচ্চ শিক্ষিতদের’ মধ্যে কর্মদক্ষ- এমন লোক খুবই কম!
সরকারের উচিত বছর বছর নতুন প্রতিষ্ঠান না করে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে মানুষকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা। তাহলেই দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ হবে। স্বাধীনতা এবং মুক্তির চেতনা ফিরে পাবে। আজও এই দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার সমাধান হলো না, ঝুলে আছে ২১, ১১ ও মুক্তির সনদ ৬ দফা!
পৃথিবীতে এমন বহু দেশ রয়েছে যেখানে বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল খুব একটা নেই। বাজেট কখন উত্থাপিত হয়, কখন পাস হয় নাগরিকরা তা জানেন না, খোঁজখবর রাখেন না প্রায়ই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহে। অধীর আগ্রহে খোঁজখবর রাখলেও হতাশ হয়ে বাসায় ফেরে বেকার সমাজ!
তাছাড়া দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। প্রতিবছর নতুন করে কমপক্ষে ২০ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে শ্রমবাজারে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট করে কোনো রূপরেখা থাকে না। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তাই বরাবরের মতো সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঘোষিত হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট।
প্রতিটি দেশের বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানোর একটি রূপরেখা থাকে। এটিই থাকে বাজেটে তরুণদের মূল আকর্ষণ, কিন্তু বাংলাদেশে তা উপেক্ষিত। ২০১০ সালে সরকারিভাবে ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় কিছু সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নানা অনিয়মের কারণে তা টেকসই হয়নি। এরপর নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। (মাসুম বিল্লাহ ৮ জুন ২০১৮ শেয়ার বিজ)  
বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা যায় ভারতে বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অন্যদিকে সিডার বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে, পরিস্থিতি হয়তো তার চেয়েও ভয়াবহ।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্রাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশাল-সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন।
এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান বা নেপালের পরিস্থিতিও তেমন একটা ভালো নয়। ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ আর নেপালে ২০ শতাংশ মানুষ চাকরির সন্ধান করছেন। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সমপর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত।
অন্যদিকে সার্বিক পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। ইনডেক্স মুন্ডি বলছে, বাংলাদেশে সার্বিক বেকারত্বের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫.০ শতাংশ, ভারতে ৮.৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ৬.৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় এই সংখ্যা ৫.১ শতাংশ। বিশ্বের সর্বাধিক বেকারের বাস জিম্বাবুয়েতে। শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষেরই কোনো কাজ নেই। আফ্রিকা বাদ দিলে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অবস্থাও শোচনীয়। কসোভোয় ৩১ শতাংশ, গ্রিসে ২৮ শতাংশ, স্পেনে ২৬.৩ শতাংশ, পর্তুগালে ১৬.৮ শতাংশ, ইতালিতে ১২.৪ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডে ১৩.৫ শতাংশ মানুষ বেকার।
আর সৌদি আরব, বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশে ১০.৫ শতাংশ মানুষের কোনো কাজ নেই। সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের সমস্যা হচ্ছে, তেলের ভাণ্ডার তাদের সর্বনাশের প্রধান কারণ। তারা মনে করেছিল, তেলের প্রয়োজনীয়তা কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ড. আহমেদ জাকি ইয়ামানি সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী ছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ইয়ামানি অত্যন্ত বাস্তববাদী ছিলেন। একপর্যায়ে বলেছিলেন প্রস্তর যুগ শেষ হওয়ার পেছনে প্রস্তরের অপ্রাপ্যতার কারণ ছিল না। কারণ ছিল মানুষ প্রস্তরের বিকল্প আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এক সময় তেলেরও প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে যা বিকল্প জ্বালানি আবিষ্কারের ফলে এখন অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে। সৌদি তেল এখন বিশ্ববাজারে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে সৌদি রাজকোষে টান পড়েছে। সরকার সেই দেশের সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২০ ভাগ কমিয়ে দিয়েছে।
সৌদি আরবের এখন আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে হজের মৌসুমের আয়, যে কারণে বর্তমানে একজন মানুষের হজ করতে যেতে হলে দু’তিন বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ-তিনগুণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
পণ্যনির্ভর অর্থনীতির ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই সৌদি আরবের উচিত হবে, তেলের অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা আর সৌদি আরবের মানুষকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা। সেই পরামর্শ আমার দেশের জন্যও। যৌক্তিক সময়ে আবেগকে সংযত করে দেখে এবং ঠেকে শেখার ইতিবাচক মানসিকতা রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
যত দিন যাচ্ছে তত স্বাভাবিক জীবনে সুখ আকাশে উঠছে। ফলে নির্ভরতার বদলে কথিত পড়ার নামে, উচ্চশিক্ষিত ভাইটি হয়ে উঠছেন বড় বোঝা। বরং কম শিক্ষিত ও অশিক্ষিতরা কোনো না কোনো কাজ পাচ্ছেন; আর সমাজে নিগ্রহের পাত্র হয়ে হতাশায় ডুবছেন উচ্চ শিক্ষিতরা। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে অধিকাংশ বেকার চাকরিতে ঢোকার ৩০ বছর বয়সসীমা পার করছেন আবেদন করে করেই। মাস্টার্স সম্পন্ন করা ছেলেমেয়েরা আবেদন করছেন এমএলএসএস পদে; কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা।
তাই কবির মুখে বলতে হয় সরকারি চাকরির লোভ ত্যাগ করা উচিত শিক্ষিতদের। এতে তাদেরই মঙ্গল। মনে রাখবেন, রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় ১০০% মানুষ শিক্ষিত হবে। কিন্তু সবাই তো সরকারি জব পাবে না। কাউকে ঠেলা চালাতে হবে, কাউকে ধান রোপণ করতে হবে, কাউকে ইলেক্ট্রিশিয়ান হতে হবে। তো, কারা হবে এসব? এক সময় মাস্টার্স পাস করেও আপনাকে ধান লাগাতে হবে, জুতো সেলাই করতে হবে।
আরও মনে রাখা ভালো, জ্ঞানদরিদ্র সমাজে চারিত্রিক ও মানসিক ; জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি করতে হলে সত্যিকারের শিক্ষা আমাদের লাভ করতে হবে। দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের বিশালতায় উন্মুক্ত করতে হবে নিজেদের- বলাকার মতো। তাহলে ঈদ হবে প্রতিদিন। আনন্দ মনে তরুণরা এগিয়ে গেলে দেশ এগিয়ে যাবে। সময় ও সমাজ সুন্দর হবে। আর মনে রাখা ভালো তরুণদের কাঁধে ভর করেই এগিয়ে   চলে পৃথিবী।

ইমরান মাহফুজ : কবি, গবেষক
ও সম্পাদক কালের ধ্বনি

 
Electronic Paper