জেনির অসীম অবদান
ইবরাহিম পাঠান
🕐 ১২:০৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৩, ২০১৯
জেনি ফন ভেস্টফালেন বা জেনি মার্কস। কার্ল মার্কসের সহধর্মিণী হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী দর্শনকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বামীর দর্শনকে এগিয়ে নিতে তার ত্যাগ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। উত্তর জার্মানের সলসভেদেলে শহরে ১৮১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। মৃত্যু হয় ১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর। ৬৭ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। কার্ল মার্কসকে বিয়ে করার পর তার নাম হয়ে যায় জেনি মার্কস। তার পুরো নাম জোহানা বার্থা জুলিয়া জেনি ফন ভেস্টফালেন।
জেনি মার্কসের মতো একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো কার্ল মার্কস হতে পেরেছিলেন একজন সমাজ পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক দার্শনিক ও বিপ্লবী! জেনি মার্কসের মেয়ে এলিনর মার্কস এভেলিং তার মাকে স্মরণ করে লিখেছিলেন, ‘স্ত্রী জেনি মার্কসের সহায়তা না পেলে কার্ল মার্কস কোনো কিছুই করে যেতে পারতেন না।’ জেনি মার্কসকে ছাড়া কার্ল মার্কস ছিলেন যেন হালবিহীন বা পালবিহীন নৌকার মতো।
ম্যারি গ্যাব্রিয়েল ‘লাভ অ্যান্ড ক্যাপিটাল : কার্ল অ্যান্ড জেনী মার্কস অ্যান্ড বার্থ অব এ রেভ্যলুশন’ বইয়ে কার্ল মার্কসের জীবনে জেনি মার্কসের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘তিনি (জেনি মার্কস) কার্ল মার্কসের শুধুমাত্র একজন বন্ধু বা প্রেমিকাই ছিলেন না, পরিণয় বন্ধনের ১৩ বছর আগে থেকেই জেনি মার্কস ছিলেন কার্ল মার্কসের বিশ্বস্ত বৌদ্ধিক আলোচনার সহসাথী। জেনি মার্কসকে ছাড়া কার্ল মার্কসের হৃদয় এবং বুদ্ধিজ্ঞানও কাজ করত না।’
জেনি মার্কসের সঙ্গে কার্ল মার্কসের পরিচয় ছিল ছোটবেলা থেকেই। জেনি মার্কসের ছোটভাই অ্যাডওয়ার্ড ফন ভেস্টফালেনের সঙ্গে কার্ল মার্কসের বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৪৩ সালের ১৯ জুন তারা দু’জন ট্র্রিয়ারের কাছে ক্রোয়েটসনাখ শহরে খ্রিস্টান বিবাহ রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেন। এর আগে ১৮৩৬ সালের দিকে তারা গোপনে বাগদান সম্পন্ন করেন। ১৮৪৩ সালে যখন তাদের বিয়ে হয় তখন জেনি মার্কসের বয়স ছিল ২৯ বছর আর কার্ল মার্কসের বয়স ছিল ২৫ বছর।
১৮৫০ সালের ২০ মে জেনি মার্কস ফ্রাঙ্কফুর্টের জনৈক ভাইডেমারের কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে বোঝা যায়, কী নিদারুণ অর্থকষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। কিন্তু তারপরও জেনি মার্কস কার্ল কিংবা বিপ্লবকে বিসর্জন দেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। ভাইডেমায়ারের কাছে তিনি লেখেন- ’ ...কার্লের প্রাপ্য কিছু পারিশ্রমিক পেয়ে থাকলে কিংবা ভবিষ্যতে পেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা যেন আমাদের পাঠিয়ে দেন। টাকাটা আমাদের ভীষণ, ভী-ষ-ণ দরকার।’ আর্থিক অভাব অনটনের কথা লেখার পর তিনি লেখেন, মনে করবেন না এসব তুচ্ছ ছোটখাটো দুঃখ দুর্দশা, ভাবনা চিন্তা আমার মনোবল নষ্ট করে দিয়েছে। আমি খুব ভালো করেই জানি যে আমাদের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। সত্যি সত্যি যা আমার আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং হৃদয়কে রক্তাক্ত করছে, তা হলো এই চিন্তা যে, ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য আমার স্বামীকে কতই না কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে, আমার পক্ষে কত সামান্য পরিমাণেই না তার সাহায্যে আসা সম্ভব হচ্ছে, এবং যিনি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে অসংখ্য লোকের উপকার করে এসেছেন, তিনি নিজে কত না অসহায়! কিন্তু তাই বলে, প্রিয় হের ভাইডেমার, ভুলেও এ কথা ভাববেন না যে, আমরা কারো কৃপাপ্রার্থী। এ সময় তাদের সংসারের টানাটানি থাকলেও তাদের বাড়িতে যখন কেউ আসতেন তাদের জেনি নিজের সাধ্যমতো আপ্যায়ন করার চেষ্টা করতেন।
১৮৫৭ সালের ৬ জুলাই কার্ল ও জেনি দম্পতির ৭ম সন্তানটি জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়। সেই সময়গুলোতে অনেক সময় তারা তাদের পরিবারের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে পারতেন না। পরে তার এক বান্ধবী লীনা শ্যোলা তার বাড়িতে আসেন। জেনির দুরবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং জেনিকে কিছু সহায়তা করেন। পরে ১৯৬০ সালে তারা আবার অর্থকষ্টে পড়েন। কার্ল মার্কস আমেরিকার ট্রিবিউন পত্রিকায় লেখালেখি করে যে আয় করতেন তা কমে যায়। ঠিক সেই সময় জেনি মার্কস বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের কারণে তার দুই চোখ নষ্ট হতে বসেছিল।
অপরদিকে তার মেয়েদেরও বয়স বাড়ছিল। অথচ সে অনুযায়ী আয় উপার্জন ছিল না। তবে ১৯৬৪ সালের দিকে কার্ল মার্কসের মামা/কাকা মারা গেলে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু সম্পত্তি ও অর্থ পান। এ সময় তারা অনটন থেকে কিছুটা রক্ষা পান। একই সঙ্গে এঙ্গেলসও ১৯৫০ থেকে তাদের পরিবারকে মাঝে মাঝে আর্থিক সহায়তা দিতেন। এভাবেই তাদের সংসার জীবন কেটে যাচ্ছিল। জেনি মার্কস বিচক্ষণতার সঙ্গে এই সমস্যা মোকাবেলা করে আসছিলেন এবং কার্ল মার্কসের লেখালেখি ও রাজনৈতিক কাজ যেন থেমে না থাকে সেই চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছিলেন।