সাগর-রুনি হত্যার ৭ বছর
আজও অজ্ঞাত কে খুনি, কেন খুন
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৯
একে একে সাত বছর কেটে গেছে কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত কাজই শেষ হয়নি। জানা যায়নি কে বা কারা এ দম্পতিকে হত্যা করেছিল, কেনই বা নির্মম এই খুনের শিকার হয়েছিলেন তারা। সাত বছরে ৬৩ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংস্থা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। অথচ আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্ত করা হবে। কিন্তু ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর পেরিয়ে মর্মান্তিক সে হত্যাকাণ্ডের সাত-সাতটি বছর অতিক্রম হতে যাচ্ছে, এখনো হত্যার মোটিভই আবিষ্কার করা যায়নি।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২, রশিদ লজ অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। সাগর ছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক এবং রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের একমাত্র সন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ। সে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
সাগর-রুনি হত্যার পর সারা দেশে সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। বছরের পর বছর বিচারের দাবি জানিয়েও সরকার সে হত্যার কূল-কিনারা করতে না পারায় চরম হতাশা প্রকাশ করেন সাংবাদিক নেতারা। সাগর-রুনির পরিবারের লোকজনও বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। সাগরের মা সালেহা মনির সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এই মামলা নিয়ে নানা নাটক হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোনো একটি মহলকে বাঁচাতে মামলার তদন্ত হচ্ছে না। আমার মনে হয়, হত্যাকারীরা হয়তো অনেক শক্তিশালী, সম্ভবত সরকারের চেয়েও শক্তিশালী।’ তিনি বলেন, ‘আমি তো সব কিছুই হারিয়েছি। এখন যদি বিচারটুকুও না পাই তবে কিসের আইন? সরকার যদি ইচ্ছে করে তবেই এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার সম্ভব হবে।’
তিনি জানান, মেঘের বয়স এখনো কম। এখনো তার সেভাবে কিছু বোঝার সময় হয়নি। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। এখন সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। বাবা-মা হত্যার বিচার যদি না হয় মেঘ বড় হলে তিনি কী জবাব দেবেন তাকে-সেটিই এখন চিন্তার বিষয়।
মামলার তদন্ত নিয়ে সাগর-রুনির পরিবারকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে জানিয়ে সালেহা মনির বলেন, ‘নিশ্চয়ই কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে, তা না হলে তদন্ত এগুচ্ছে ন কেন, আমরা কিছু জানতে পারছি না কেন?’
সাগর-রুনি হত্যা মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের এসপি মো. শহিদার রহমানও সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারছেন না তদন্ত শেষ করে কবে নাগাদ অভিযোগপত্র জমা দেওয়া যাবে। তবে তদন্তের প্রয়োজনে যে সব পরীক্ষা করা হয়েছিল তার সব রিপোর্ট তারা হাতে পেয়েছেন। কিন্তু তাতে কী মিলেছে তা জানাতে চাইছেন না তিনি। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় যে আটজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল, তার মধ্যে দুজন জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন এ তদন্ত কর্মকর্তা।
জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই মো. নওশের আলম রোমানের করা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই জহুরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব চলে যায় ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমের হাতে। ৬২ দিন পর ডিবি এ মামলার তদন্তে ব্যর্থতার কথা জানালে আদালত ২০১২ সালের এপ্রিলে তদন্তের দায়িত্ব দেয় র্যাবকে। এরপর র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার হাত ঘুরে তদন্তভার আসে এএসপি শহিদারের কাছে। এ পর্যন্ত এ মামলায় ছয় তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন হয়েছে।
রুনির ভাই নওশের রোমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তনের খবরও তারা জানেন না। নিজেরা যোগাযোগ করলে মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনও না। উপরন্তু মামলার তদন্তের নামে তাদের হয়রানিও করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নওশের। তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা আজও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। এ মুহূর্তে মামলাটির কোনো তদন্ত হচ্ছে না। তাকে হিমঘরে পাঠানো হয়েছে।’
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সপ্তম বছরে তদন্তের অগ্রগতি কি জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের এসপি মো. শহিদার রহমান জানান, ময়নাতদন্ত, ডিএনএ পরীক্ষাসহ তদন্তের প্রয়োজনে যে সব পরীক্ষা করা হয়েছিল, সবগুলোর ফলাফল তারা পেয়েছেন। বিদেশে করা পরীক্ষার ফলাফলও তাদের হাতে এসেছে। তবে এসব ফলাফল তদন্তের স্বার্থে জানাতে রাজি হননি তিনি। অভিযোগপত্র দাখিলের ব্যাপারে বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দিনক্ষণ দেওয়ার সুযোগ নেই। সময় হলে চার্জশিট দেওয়া হবে।’
এদিকে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার দিন রয়েছে। গত সাত বছরে এ পর্যন্ত আদালত থেকে ৬৩ বার সময় নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এবারও একইভাবে সময় আবেদন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন সাগর-রুনি যে বাড়িতে থাকতেন তার নিরাপত্তা রক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন ও আবু সাঈদ। জামিনে রয়েছেন, রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান ও বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল।
বিভিন্ন সময়ের তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, সাগর-রুনিকে কেন খুন করা হয়েছিল, তার ‘মোটিভ’ই এখনো উদ্ধার করতে পারেনি র্যাব। র্যাব তদন্তের ভার নেওয়ার পর কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ তুলে ‘ভিসেরা’ (রাসায়নিক) পরীক্ষা এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ‘ফরেনসিক’ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। এর বাইরে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির খবর জানা যায়নি। ২০১৬ সালে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা র্যাবের সহকারী পুলিশ সুপার ওয়ারেশ আলী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে যে আলামত পাঠানো হয়েছিল, তা থেকে কারোর পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়নি। ঢাকা থেকে ২১ জন সন্দেহভাজনের ডিএনএ নমুনা আলামতের নমুনার সঙ্গে মেলানোর জন্যও পাঠানো হয়। কিন্তু সে ২১ জনের মধ্যে কারোর নমুনাই আলামতের ডিএনএ-র সঙ্গে মেলেনি।
ফলে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, কেনই বা জড়িত তার কোনো ক্লু জানার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। রুনির ভাই নওশের রোমানও দাবি করেছেন এরই মধ্যে মামলার আলামত, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে।