ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হিংসার অন্ধকারে আলোর শিখা

জ্যোতির্ময় নন্দী
🕐 ৯:১৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৯

প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসী তৎপরতায় ক্ষত-বিক্ষত পাকিস্তানে এক তরুণের মানবিক সেবামূলক তৎপরতার খবর সামাজিক ও গণমাধ্যম সূত্রে জেনে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছি। খবরটা জেনে মনে হয়েছে, নাগিনীরা দিকে দিকে যতই বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলুক না কেন, শান্তির ললিত রাগিণী কোথাও না কোথাও গুঞ্জরিত হবেই।

এ কাহিনীর নায়ক আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি প্রদেশ খায়বার পাখতুনখোয়ার সোয়াত উপত্যকার ২৩ বছরের তরুণ ইরফানউল্লাহ। কঠিন শ্রমসাধ্য কর্মপরিবেশ, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি, নামমাত্র পারিশ্রমিক, আর ধন্যবাদ বা সাধুবাদের একান্ত অভাব সত্ত্বেও তার দেশে ভয়াবহ পোলিও ভাইরাস নির্মূলে তার অক্লান্ত প্রয়াস সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসে। সামাজিক মাধ্যম সূত্রেই ইরফানউল্লাহর এ প্রয়াস গণমাধ্যমের তথা বিশ্বজনের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এর সুফল এখন ভোগ করছেন তিনি একা নন, তার সব সহকর্মীরাও। পাকিস্তানের পোলিও কর্মীদের মধ্যে এ ঘটনা এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি ইরফানউল্লাহর এক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, কারাকোরাম পর্বতমালার অভ্যন্তরে অবস্থিত বাশেগ্রাম নামে একটি জায়গার শিশুদের পোলিও টিকা খাওয়ানোর জন্য তিনি কোমরসমান বরফ ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের হাজারো মানুষ ফেসবুক ও টুইটারে এ ভিডিও দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। ইরফানউল্লাহর এক বন্ধুর বানানো ভিডিওটি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু জরুরি তহবিল ইউনিসেফ তাদের সামাজিক মাধ্যম পেজে পোস্ট করার পর দেশ-বিদেশে সর্বত্র সাড়া পড়ে যায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত ২৯ জানুয়ারি ইরফান ও তার কয়েকজন সহকর্মী বন্ধুকে ইসলামাবাদের পিএম হাউসে আয়োজিত এক বিশেষ বৈঠকে সংবর্ধনা দেন।

তার পরদিন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক টুইটার বার্তায় ইরফানউল্লাহ এবং পাকিস্তানকে পোলিওমুক্ত করার জন্য কর্মরত আরও হাজারো টিকাদানকারীর উচ্চ প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘ইরফান হচ্ছেন সেই বীরদের একজন যারা চরম আবহাওয়া পরিস্থিতিতেও শিশুদের পোলিও টিকা পৌঁছে দেন। তার ভাইরাল ভিডিও দেশের প্রতিটি মানুষকে বিস্ময় আর গর্বে ভরিয়ে তুলেছে। এই নিষ্ঠাই পারবে আমাদের (পাকিস্তানকে) পোলিওমুক্ত স্বদেশ গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। সালাম, হে পোলিও কর্মী।’ এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ইরফানউল্লাহ বলেছেন, এই সম্মান ও স্বীকৃতি অবশ্যই ভালো লাগছে। কিন্তু এটা যেন দেশকে পোলিওমুক্ত করার জরুরি প্রয়োজনীয়তার বোধ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে না দেয়।

সোয়াত জেলার মাদিয়ান গ্রামের এই মৃদুভাষী তরুণ স্থানীয় চাইল্ড স্বাস্থ্য কেন্দ্রের টিকাদাতা টিমের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেন। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এ জেলার প্রতিটি টিকাদান অভিযানে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি কখনো ভোলেন না। তিনি বলেন, ‘আমি পার্বত্য এলাকায় বড় হয়েছি। এই উঁচু-নিচু ভূমি আর কঠোর আবহাওয়া আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এবার অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর তুষারপাতের ফলে পরিস্থিতিটা আরও একটু কঠিন হয়ে গেছে বটে।’ এমন আবহাওয়ায় কর্তব্যের তাগিদে অতিদুর্গম এক পার্বত্য গ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ওই ভাইরাল ভিডিওটি তোলা প্রসঙ্গে ইরফান বলেছেন, ‘আমি তো শুধু আমার নিজের কাজটুকুই করছিলাম। খ্যাতি বা স্বীকৃতি কখনই আমার লক্ষ্য ছিল না। সম্প্রতি দিনগুলোতে যে পরিমাণ মনোযোগ পাচ্ছি, তেমনটা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।’

তবে বছরের পর বছর বৃহত্তর লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কাজ করে যাওয়ার পর এই সুনামটা পেয়ে তার যে ভালো লাগছে, একথাটাও ইরফান স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, ‘দুনিয়া যে আমাদের প্রচেষ্টার মূল্যায়ন করছে তাতে আমরা আনন্দিত। আশা করি, পাকিস্তানের পোলিও নির্মূল প্রয়াস এতে আরও জোরদার হবে। আমরা দেখতে চাই, শুধু পাকিস্তানে নয়, সমগ্র বিশ্বেই পোলিওর পরিসমাপ্তি ঘটুক।’

অসামান্য কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য ইরফানের নিজের জেলার লোকজনও তার ঢের প্রশংসা করেছে। তারা স্বীকার করেছে ইরফানউল্লাহর মতো কঠোর পরিশ্রমী আর দেশপ্রেমী মানুষরাই পাকিস্তানের প্রকৃত সম্পদ। এখন তাদের বেতন ও অন্যান্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে সরকার অচিরেই উদ্যোগ নেবে, এমনটাই আশা প্রকাশ করেছেন তারা।

ইরফানউল্লাহ আসলে মানবতার সেবায় কী করেছেন বা কতটুকু করেছেন, কারাকোরামের ভয়ঙ্কর, অতিদুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত দুরধিগম্য গ্রামগুলোর শিশুদের জন্য পোলিও টিকা পৌঁছে দিতে কোমরসমান বরফ ঠেলে তার এগিয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য দৃশ্যটি না দেখলে তা বোঝা যাবে না।

এ জন্য দৃশ্যটির একটি আলোকচিত্রও এ লেখার সঙ্গে যুক্ত করা হলো। মনে রাখতে হবে, খাইবার পাখতুনখোয়ার এ এলাকাটি জঙ্গি তৎপরতার জন্য কুখ্যাত। কাছের ও দূরের অতীতে বহু রক্তপাতের ইতিহাস এখানকার মাটির সঙ্গে মিশে আছে। অথচ এরই মধ্যে ইরফানউল্লাহর মতো মানুষরা রচনা করছেন অন্যরকমের এক ইতিহাস। সে ইতিহাস হত্যা ও হিংসার নয়, বরং জীবনদানের আর ভালোবাসার। দেশে দেশে যুগে যুগে এমন মানুষরাই মানুষের প্রাণে জ্বালিয়ে রাখেন আশার আলো। বীর আর নায়কদের দেখা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে বা রুপালি পর্দাতেই মেলে না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, আমাদের পাশে পাশেই তারা আছেন, নিয়ত সহায়তার, সহযোগিতার উদার হাত বাড়িয়ে রেখে। ইরফানউল্লাহ তাদেরই একজন।

সত্যি বলতে কী, তারাই সমাজের প্রকৃত বীর নায়ক। আজকের পৃথিবীতে একজন বীর যোদ্ধা বা চিত্রনায়কের চেয়েও অনেক বেশি দরকার এই ইরফানউল্লাহর মতো মানুষদের। তাদের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই এ পৃথিবী আরও বেশি মানবিক, আরও বেশি বসবাসযোগ্য হয়ে উঠবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এরাই হয়ে থাকবেন সঠিক পথের দিশারি আলোর শিখা।

জ্যোতির্ময় নন্দী : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
[email protected]

 
Electronic Paper