আমার গলা উঁচু, তাই ক্ষমতায়
রুচির যোশী
🕐 ৯:৩৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০১৯
রুচির যোশী লেখক, কলামিস্ট ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’-তে তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয় গত ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে। ভাষান্তর করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী
ছোটবেলায় আমাদের অনেকের ধারণা ছিল, কোনোকিছুর-যেমন একটা টিম, একটা ক্লাস বা একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব পাওয়া মানেই হলো তোমাকে বিস্তর চেঁচাতে হবে। উঁচু গলায় এবং অবিরাম কথা বলে যাবেন, এবং তারপর হঠাৎ গিয়ার বাড়িয়ে, গলা ফাটিয়ে গর্জন করে উঠবেন, আমাদের মনে হতো, এটাই একজন সত্যিকারের নেতার লক্ষণ। এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, কারণ আমাদের চারপাশে সবাই এভাবে জোরগলায় নিজেকে নেতা হিসেবে জাহির করার পদ্ধতিতেই বিশ^াসী। বাড়িতে বেশিরভাগ বাবা-মা (অথবা তাদের মধ্যে অন্তত একজন) চেঁচাতেন। রাস্তায় স্কুলবাস ড্রাইভার আমাদের স্কুলে নেওয়ার পথে বাসটাকে ঢুঁ-মারা ভেড়ার মতো চালাতে চালাতে তার চেয়ে কম পদমর্যাদাধারী যানচালক, যেমন ট্যাক্সিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালাদের চেঁচিয়ে হম্বিতম্বি করত। স্কুলে প্রচুর চেঁচাতেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা, আর সেই সঙ্গে ওই বাচ্চারাও, যেগুলোকে ক্লাস ক্যাপ্টেন বা মনিটর হিসেবে অন্য বাচ্চাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খেলার মাঠে সেই বাচ্চারাই এ দল বা ও দলের দায়িত্ব পেত যাদের গলা সবচেয়ে উঁচু আর অসহনীয়।
শব্দমাত্রা গণনার সমাজতত্ত্ব
এ নিয়ে এক বন্ধু একটা তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করেছিল। তাতে সে বলেছিল, আমরা যারা স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে বড় হয়ে উঠেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই সেই নবজাত দেশে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে ভেবেছে, চিৎকার না করলে তাদের কথা কেউ শুনবে না বা মানবে না।
আরেক বন্ধুর মত ছিল, এর মধ্যে শ্রেণিগত দিকও রয়েছে, যেমন-রাস্তায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যাবে দলের নেতা কোনো একটা সাধারণ নির্দেশও দিচ্ছে জোর গলায় চেঁচিয়ে। কিন্তু যতই তুমি অর্থনৈতিক মই বেয়ে ওপরের দিকে যাবে ব্যবস্থাপনার কণ্ঠস্বর ততই নিচু বা মৃদু হয়ে আসবে। এ দুটো তত্ত্বই ভালো এবং কিছুদূর পর্যন্ত ঠিক। কিন্তু তারপর এগুলো আর বাস্তবতার ধোপে টেকে না। লোকেরা ’৮০ আর ’৯০-এর দশকেও চেঁচিয়েছে এবং এখনো চেঁচাচ্ছে। করপোরেট হাউস বা অ্যাডভারটাইজিং ফার্মে মাইকেল ডগলাসের ভাব নেওয়া ষণ্ডামার্কা আর স্বৈরাচারী বসদের যারা দেখেছে, তারা জানে, আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো সৌখিন বিজনেস স্কুল এ সার্জেন্ট-মেজর পদ্ধতিতে অধস্তনদের পেছনে কাঠি দেওয়া প্রতিরোধের কোনো শিক্ষা দেয় না বা দিতে পারে না। সত্যি বলতে কী, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ শিবিরে যা শেখানো হয়, তাতে ঘন ঘন বিস্ফোরণের সম্ভাবনাকেই বাড়িয়ে তোলে।
ছেলেবেলায় আমি আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা কল্পনার জগতেই সারাক্ষণ হারিয়ে থাকতাম এবং অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের কোনো পার্থিব প্রকল্পে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
কিন্তু যেটা আমার ভালো লাগতো না এবং যেটার বিরুদ্ধে আমি প্রতিক্রিয়া দেখাতাম সেটা হলো, অন্য ছেলেরা আমরা বাকিদের ওপর আধিপত্যের ক্ষমতা পেয়ে সেটা খুব উপভোগ করছে। তারা আমাদের নানারকম আদেশ দিতে, তা না মানলে নানারকম যন্ত্রণা দিতে, এবং সর্বোপরি চিৎকার করে হুকুম দিতে খুব পছন্দ করত। আমি এবং আমার আরও কয়েকজন সহপাঠী এসব সার্জেন্ট-মেজর টাইপ ছেলেদের মাথাব্যথার কারণ হতে খুব পছন্দ করতাম। আমরা তাদের হুকুমমতো কাজটা করতাম না যে তা নয়, কিন্তু সেটা করতাম শম্বুকগতিতে। হুকুমকারীরা যত জোরে চেঁচাতো, আমরা ততই বধির হয়ে যেতাম; আমাদের ডানে যেতে বললে আসরা যেতাম বাঁয়ে, এবং এর পরিণামও ভোগ করতাম।
মান্য কণ্ঠস্বর
একপর্যায়ে আমরা হাইস্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠে পড়লাম, এবং তখন হঠাৎ করে আমার কিছু বন্ধুকে দেখতে পেলাম তাদের মধ্যে, যাদের আমি ছাত্র-পুলিশ বলেই মনে করতাম। আমার এক বন্ধু, মনোবৈকল্যের ওপর যার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না (এবং যে ছিল চুপচাপ নিয়মিত নিয়ম ভাঙার ওস্তাদ, তাকেও একসময় মনিটর বানানো হলো। এ ছেলেটা, যাকে আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম, সে এমন এক নিয়ম বানালো যেটাকে আমার প্রশংসা করতেই হলো : সে এমন এক মান্য স্বরে নানা আদেশ-নির্দেশ দিতো, যেটা অবশ্যই মানা হবে বলে আশা করা হতো, অথচ যার মধ্যে কোনো রাগ বা বিদ্বেষ ছিল না। কোনো বাধার সম্মুখীন হলে সে কিছু শাস্তি বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতো, যার মধ্যে অবশ্যই থাকত রাগের বদলে একটা মজা করার ভাব। জীবনে এর পর যখন ফিল্ম বানানোর জগতে ঢুকলাম, তখন দেখলাম এভাব এবং কৌশলটা খুব কাজে আসছে।
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের কাজ দেখতে গিয়ে অনেকে নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, তারা চিৎকার করে কোনো আদেশই দেন না, বরং কোনো সহকারীর কানে কানে বলা একটা শব্দই স্পষ্টভাবে উচ্চারিত কিছু আদেশের একটা ধারাবাহিকতা তৈরি করে দেয়। অবশ্য বসকে সেটা দেখাবার দরকার হলে, তাদের গলার আওয়াজ একটুও না তুলে ঘটানো ছোট্ট একটা বিস্ফোরণ যে কোনো গর্জন-আস্ফালনের চেয়ে বেশি কার্যকর হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাদের দেখেছি, খেয়াল করলাম, তাদের মধ্যে তারাই বেশি সফল যারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না বা সহজে গলা তুলে কথা বলে না। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, নিজের আত্মসম্মান এবং যাদের আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, উভয়পক্ষের জন্য এটা ভালো। আমাদের সমাজে অধীনস্থদের ওপর চিৎকার-চেঁচামেচির ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং এটা সামাজিক শ্রেণি ও জাতপাতের ওপর নির্ভর করে। যে কোনো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি ও হ্রস্বমেয়াদি উভয় ধরনের পদবিন্যাস বা অবস্থানবিন্যাস অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, এ ক্ষমতার সমীকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কী করে আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন? দেশীয় পরিস্থিতিতে বা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য আমাদের গতিশীলতা অনন্য সাধারণ হতে পারে, কিন্তু তারপরও সামন্তবাদী গর্জন, চিৎকার, ক্রোধের অসংযত বহিঃপ্রকাশের প্রবণতা থেকে আমরা যতই বেরিয়ে আসতে শিখবো, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল হবে।