ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তরুণ সমাজের নতুন হুমকি ই-সিগারেট

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইন সংশোধন অপরিহার্য

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
🕐 ৮:৩৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইন সংশোধন অপরিহার্য

বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট) এর ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক তরুণের কাছে এখন ইলেকট্রনিক সিগারেট ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইতিমধ্যে অনেক দেশ ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ করেছে।

যা আছে সংশোধনীতে

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে যেখানে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এধরনের সকল পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া খসড়া আইনে সকল ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, এর যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ইত্যাদি) হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস, হিট নট বার্ন এবং ওরাল নিকোটিন পাউচ যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এগুলোর উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। কেউ এই ধারা লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। পাশাপাশি, যেকোন ব্যক্তির জন্য এসব পণ্যের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ই-সিগারেট/ভেপিং ঠিক কতটা ক্ষতিকর?

অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত WHO Report on Global Tobacco Epidemic 2021 এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ENDS) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যক্ষতি তৈরি করে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬ এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারির আকার ধারণ করলে এই ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসগুলোর সত্যিকারের চেহারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। উল্লেখ্য, জনস্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ মোট ৩২টি দেশ ভেপিং নিষিদ্ধ করেছে।

ই-সিগারেট বা ভেপিং-এর ফলে ধূমপায়ীরা সিগারেট ছেড়ে দিতে উৎসাহী হবেন- এমনটা দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট ভবিষ্যতে তামাকপণ্য ব্যবহারের “gateway” হিসেবেও কাজ করে। এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, ই-সিগারেট ব্যবহার করেন এমন কিশোর-তরুণদের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যেই সিগারেট ব্যবহার শুরুর সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় চার গুণ বেশি। অর্থাৎ সিগারেট থেকে মুক্তি নয়, বরং তরুণদের সিগারেট আসক্তির দিকেই নিয়ে যায় ভেপিং। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন লবিস্ট গ্রুপের দাবি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এখনো ধূমপানে আসক্তি কমাতে সহায়ক পণ্য হিসেবে ভেপিং বা ই-সিগারেটকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং ২০১৭ সালে তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ও ভেপিং এর ব্যবহার কমাতে ‘দ্য রিয়েল কস্ট’ নামের একটি ক্যাম্পেইন চালু করে এফডিএ।

ভেপিং বাস্প পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে দেহের ক্ষতি হয় না – এমন একটি দাবি ই-সিগারেট ও ভেপিং ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন দাবি করে আসলেও তা এখন অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অসংখ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে যে, ভেপিংয়ের পরোক্ষ ধোঁয়া (secondhand smoke) অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং তা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার এমন ব্যক্তির শ্বাসযন্ত্রে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
রক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে

সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠির প্রায় ৪৮ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সময়কাল অতিবাহিত করছে যেখানে, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির সংখ্যা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে ক্ষতিকর ইলেকট্রনিক সিগারেটের ব্যবহার বেশ চোখে পড়ছে। অন্য তরুণদেরও এটি আকৃষ্ট করছে।

অথচ একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনে তরুণ জনগোষ্ঠির অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট বা ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং ও হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ই-সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে।

দ্রুত আইন সংশোধনের তাগিদ দিয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিদ্যমান আইন সংশোধনের গুরুত্ব অনেক। তবে আশার কথা সংশোধনীর মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আমরা যারা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করছি, তারা চাই, এ আইন সংশোধন হোক। আর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের চাবিকাঠি হচ্ছে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।

 
Electronic Paper