ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জ্বালানির অজুহাতে পুড়ছে বাজার সিন্ডিকেট

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১:০১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২২

জ্বালানির অজুহাতে পুড়ছে বাজার সিন্ডিকেট

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় লাগামহীন হয়ে পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। চাল, ডাল, তেল, ডিম, আটা, চিনি থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। বেড়ে গেছে পরিবহন ভাড়াও।

দ্রব্যমূল্য বাড়লেও আয় না বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষ। টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে এখন অনেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় কাটছাঁট করছেন, ভাঙছেন সঞ্চয়। বিভিন্ন অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়তি পরিবহন ভাড়াকে দুষছেন। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাড়তি ভাড়ার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি মূল্যবৃদ্ধি করছে অসাধু সিন্ডিকেটগুলো।

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তবুও সংকট : কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে চালের উৎপাদন চাহিদার চেয়েও বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। চাহিদা ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার টন। সেই হিসাবে দেশে প্রায় ৮৬ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবুও বিভিন্ন অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে বস্তায় ২৮ টাকা, কেজিতে ৫৮ পয়সা রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে চাল যায় পুরান ঢাকার বাদামতলীর চালের আড়ৎগুলো থেকে।

ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ভরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চাল আসে এসব আড়তে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন খরচ কতটুকু বেড়েছে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে বাদামতলীতে অনুসন্ধান চালায় দৈনিক খোলা কাগজ। নওগাঁ থেকে আসা মো. ইসমাইল হোসেন নামের এক ট্রাকচালকের সঙ্গে আলাপ হয় সেখানে। ২৮০ বস্তা চাল নিয়ে এসেছেন তিনি। তার কাছ থেকে জানা গেল জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন খরচ বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার টাকা।

আগে কত টাকা ভাড়া ছিল জানতে চাইলে এই ট্রাকচালক বলেন, আগে নওগাঁ থেকে ২৮০ বস্তা চাল ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়া লাগত ১২ হাজার টাকা। তার সঙ্গে বস্তাপ্রতি লেবার খরচ ও আড়তদারি বাবদ গুনতে হত আরো ১৪ টাকা করে। অর্থাৎ ৩ হাজার ৯২০ টাকা। সবমিলে এক ট্রাক চালের পরিবহন খরচ দাঁড়াত ১৫ হাজার ৯২০ টাকা। এতে প্রতি বস্তা চালের পরিবহন খরচ দাঁড়ায় ৫৬ টাকা আর প্রতিকেজি চালের পরিবহন ব্যয় হয় ১ টাকা ১২ পয়সা।

বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়তি পরিবহন খরচের চিত্র তুলে ধরে ইসমাইল বলেন, এখন তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ এখন শুধু ট্রাক ভাড়াই লাগে ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে বস্তাপ্রতি লেবার খরচ ও আড়তদারি বাবদ আরও ৩ হাজার ৯২০ টাকা যুক্ত হয়ে পরিবহন ব্যয় দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৯২০ টাকায়। বাড়তি ৮ হাজার টাকার হিসাব অনুযায়ী বস্তাপ্রতি চালের পরিবহন খরচ বেড়েছে ২৮ টাকা। আর কেজি প্রতি বেড়েছে ৫৮ পয়সা। এই পরিবহন শ্রমিকের হিসাব অনুযায়ী কেজি প্রতি চালে পরিবহন ব্যয় মাত্র ৫৮ পয়সা বাড়লেও অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে দেশের বাজারে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ৬ টাকা করে।

সিন্ডিকেটেই বাজারে আগুন : হঠাৎ করে চালের দাম হু হু করে বৃদ্ধির বিষয়ে মিল মালিকরা বলছেন, কৃষকরা ধান বিক্রি না করায় চালের সংকট সৃষ্টি হয়েছে; এ কারণে দাম বাড়ছে। অথচ বাস্তবে তাদের এ দাবির সত্যতা মেলেনি। কারণ এ সময় কৃষকের গোলায় ধান থাকার কথা নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধান কৃষকরা অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন যা ধান রয়েছে তার পুরোটাই মিল মালিকদের কাছে। চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চালের মোকামগুলোতে অতিরিক্ত দাম হাঁকানো হচ্ছে। বাড়তি দামে চাল আনতে হচ্ছে সেজন্য বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি মূল্যে। তাই অনেক ব্যবসায়ীই আপাতত চাল আনা বন্ধ রেখেছেন।

সুত্রাপুর বাজারের চাল ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম খোলা কাগজকে বলেন, এ বছর বোরোতে উৎপাদন অনেক কম হয়েছে। সেজন্য সরকার ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাজারে ভারতের চাল এখনো আসেনি। এ পর্যন্ত যা এসেছে তা মিল মালিকদের কাছে আছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের কারণে ট্রাকভাড়া বেড়েছে। বাড়তি ভাড়ার কারণে প্রতিকেজি চালে প্রায় ৬০ পয়সার বেশি খরচ হচ্ছে। এ সুযোগে মিল মালিকেরা কারসাজি করে চালের দাম কিছুটা বাড়িয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহন খরচ। এসব কারণেই মূলত চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা উচ্চমূল্য নেয়ার জন্য এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী সময়ে চালের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। আর মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫৩ থেকে ৫৮ টাকায়।

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ডিমের বাজারও : এদিকে প্রায় প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে ডিমের দাম। আর এই দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। তারা প্রতিদিন রাত ১০টায় সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে প্রতিদিনের ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে। বিনিময়ে খামারিদের কাছ থেকে পায় ১৫ শতাংশ কমিশন। আর খামারিরাও তাদের নির্ধারণ করা দামে ডিম বিক্রি করে থাকেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন শাহজালাল মার্কেটে রয়েছে একটি ডিমের আড়ৎ। এখানে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। এই সমিতির সদস্যরাই রাতে মিটিং করে নির্ধারণ করে ডিমের দাম।

সমিতির সভাপতি ওবায়দুল খান বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজার দাম সংগ্রহ করি। আমাদের সমিতির সদস্যরা বসে রাত ১০টায় মিটিং করি। এখানে সদস্যদের ভোটের ওপর দাম নির্ধারণ করি। এই দাম রাতেই খামারিদের জানিয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন সেই দামেই বিক্রি হয় ডিম।

মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খাদ্যের দাম বেশি, বিদ্যুতের দামসহ খামার চালানোর খরচ বেড়ে গেছে। ফলে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন কমে গেছে, চাহিদা বেড়েছে। এ কারণেই ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সব দিক বিবেচনা করে বাজার দর নির্ধারণ করি।

তবে পাইকারি ব্যবসায়ী সাইফুল আলম বলেন, প্রতি একশ’ পিস ডিমে দাম বেড়েছে প্রায় ২৫০ টাকা। প্রতি রাতেই ডিম ব্যবসায়ী সমিতি দাম ঠিক করে দেয়। সেই দামেই আমরা ডিম কিনে বিক্রি করি। এই সিন্ডিকেটের উপরই নির্ভর করে সারাদেশের ডিমের বাজার।

বাড়ছে চিনির দামও : গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। ওই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর মুখ দেখার আগেই বাজারে বেড়েছে চিনির দাম। কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতে চিনির দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা।

গত রোববার রাজধানীর মৌলভীবাজারে পাইকারিতে খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ৮৭ টাকা কেজি। খরচসহ কারওয়ান বাজারে সেই চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেই এসব দোকানে পাইকারিতে চিনি বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ৮১ থেকে ৮২ টাকায়। গত বৃহস্পতিবার দাম ছিল ৮৩ থেকে ৮৫ টাকা। অবশ্য প্যাকেটজাত চিনি ৮৫ টাকা কেজির আশপাশে মিলছে। তবে বাজারে এই চিনির সরবরাহ কম।

চালের দামের সমান আটার দাম : চালের দাম বাড়ার পর একলাফে কেজিতে পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেড়েছে আটার দাম। তাতে এখন এক কেজি মোটা ও মাঝারি মানের চালের দামে কিনতে হবে এক কেজি প্যাকেটজাত আটা। আর খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে এক কেজি মোটা চালের আশপাশে।

গত রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নতুন দামের খোলা আটা বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৫০ টাকা দরে। এর আগে কেজি প্রতি খোলা আটার দাম ছিল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। এদিকে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো আটার দুই কেজির প্যাকেটের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। এখন ২ কেজির প্যাকেটজাত আটা মিলছে ১১২ থেকে ১১৫ টাকায়, যা আগের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি। এ হিসাবে প্যাকেটজাত ও খোলা উভয় আটায় প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা।

বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকি-সমন্বয় জরুরি : ক্যাব সভাপতি বলেন, ভোক্তা স্বার্থ উদ্ধারে বাজারে বেশ কয়েকটি সংস্থা তদারকি করে। সেসব প্রতিষ্ঠানকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাই সমন্বয় রেখে অনিয়ম পেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, পণ্য পরিবহণের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। এজন্য চালক ও মালিক ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। এছাড়া এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। তাই পণ্য পরিবহণে কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। তখন নির্দিষ্ট ভাড়ার বেশি আদায় করা যাবে না। তবে সরকার আমাদের এ পরামর্শ আমলে নেয়নি।

 
Electronic Paper