রাজধানীতে অপ্রতিরোধ্য অটোরিকশা চোরচক্র
রাজু আহমেদ
🕐 ১:২৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০২২
রাজধানীতে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার ছিনতাইকারী চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যাত্রীবেশে অভিনব কায়দায় মোটরসাইকেল, অটোরিকশা কিংবা সিএনজি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মরণঘাতি আঘাত কিংবা নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করতেও এতটুকু বুক কাঁপেনা তাদের।
সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগের পল্লবী থানায় একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও সিএনজি চুরির ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। ছায়াতদন্তসহ বিশ্বস্ত সোর্সদের সহযোগিতায় পুলিশের একাধিক চৌকস আভিযানিক দল মাঠে নেমে অভিযান পরিচালনা করে দু’সপ্তাহের ব্যবধানেই আন্তঃজেলা গাড়ি চোর ও ছিনতাইকারী চক্রের তিনটি গ্রুপকে গ্রেফতার করেছে পল্লবী থানা পুলিশ।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ আগস্ট সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পল্লবী এলাকা থেকে আল-আমিন (৩৮), ফরিদ (৩৫), হোসেন মিয়া (৩৫), নাইম (২০) ও কামাল (৩২) নামে আন্তঃজেলা সিএনজি অটোরিকশা চোর চক্রের পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পল্লবী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় পল্লবী থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) আজিজ বাদী হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা দায়ের করেন। পল্লবী থানার মামলা নম্বর ২৯, তারিখ-০৭-০৮-২০২।
গাবতলীর পার্শ্ববর্তী গৈদারটেক এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া নামে একজন অটোরিকশা চালক জানান, গত ৩ আগস্ট রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে গাবতলীর মাজার রোড থেকে যাত্রী বেশে ১৫০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দুই যুবক পল্লবীর পুরবীতে যাবেন বলে আমার রিকশায় ওঠেন। কিন্তু মিরপুর সাত নম্বর সেকশনের মিল্ক ভিটা সড়কের ঢালে পৌঁছতেই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তারা দুজন রিকশা থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে তাদের একজন কোমড় থেকে একটি চকচকে চাপাতি বের করে আমার গলায় ঠেকিয়ে বলে, তোর কাছে কি আছে সব বের কর। জান বাঁচাতে চাইলে রিকশা রেখে দৌড় দে, পালিয়ে যা।
আমি ভয়ে কি করবো বুঝতে না পেরে ডাকচিৎকার শুরু করি। এই ফাঁকে দুই ছিনতাইকারীর একজন চাপাতি দিয়ে আমার গলায় সজোরে কোপ দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি দ্রুত লাফ দিয়ে পাশের দেয়াল টপকে যাই। চাপাতির কোপ আমার গলায় না লাগলেও আমার হাতে সামান্য কেটে যায়। ইতোমধ্যে আমার চিৎকার শুনে উপস্থিত জনতা এগিয়ে এসে দেশীয় অস্ত্র চাপাতিসহ একজনকে হাতেনাতে ধরে ফেললে আরেকজন দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় জনতা বিজয় (২৩) নামের ওই ছিনতাইকারীকে ওই রাতেই পল্লবী থানায় হস্তান্তর করে।
এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পল্লবী থানার এস আই রোমান বলেন, গত ৩ আগস্ট রাত আনুমানিক ৩টার দিকে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে হাতেনাতে ধরেছেন দাবি করে স্থানীয় কিছু জনতা বিজয় (২৩) নামে একজন যুবককে থানায় নিয়ে আসে। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে সবকিছু স্বীকার করে সঙ্গীয় পলাতক মুন্না নামে অপর ছিনতাইকারীর বাসার ঠিকানা দিলে ওই রাতেই অভিযান পরিচালনা করে অপর অভিযুক্ত মুন্নাকে গ্রেফতার করে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
এর আগে গত ২৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল ৭টার দিকে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ই-ব্লকের কুর্মিটোলা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী কালশী নতুন রাস্তা থেকে লতিফ হাওলাদার (৬০) নামে একজন অটোরিকশা চালকের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটিও শুধুমাত্র তার অটোরিকশা ছিনতাইেদর উদ্দেশ্যেই ঘটেছিল বলে জানিয়েছিলেন পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পারভেজ ইসলাম।
এর আগে গত ২৯ জুলাই রাত আনুমানিক দুইটার দিকে পল্লবী থানাধীন সুলতান মোল্লা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সংলগ্ন আব্দুল লতিফ মিয়ার বাড়ির সামনের পাকা রাস্তায় একটি গলাকাটা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন পল্লবী ৯৯৯ এ কল করার মাধ্যমে পল্লবী থানায় খবর দেয়। সংবাদ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে পল্লবী থানার একটি টহল পুলিশের টিম তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে। সেখানে জিন্সের প্যান্ট পরিহিত গলাকাটা লাশ ও পাশেই একটি হেলমেট পড়ে থাকতে দেখতে পেয়ে প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করে, কোনো মোটরসাইকেল চালককে হত্যা করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে বেতারবার্তার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী সকল থানাকে ঘটনাটি জানিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেতারবার্তার প্রেক্ষিতে রাত আড়াইটার দিকে সাভারের বিরুলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির একটি টিম দ্রুতগতিতে আসা একটি মোটরসাইকেলের গতিরোধ করতে সিগনাল দিলে চালক মোটরসাইকেলটি না থামিয়ে বরং দ্রুতগতিতে উল্টো দিকে ঘুরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে তাকে ধাওয়া করে আটক করে তার পরনের পোশাক ও মোটরসাইকেলে রক্তের দাগ দেখে তাৎক্ষণিকভাবে পল্লবী থানাকে অবহিত করেন বিরুলিয়া পুলিশ ক্যাম্পের ওই টিম। দ্রুত সময়ের মধ্যে পল্লবী থানা পুলিশের একটি টিম সেখানে পৌঁছে তাকে গ্রেফতার করে মোটরসাইকেলটি হেফাজতে নেন এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি তার নাম কাওসার আহমেদ দাবি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্বীকার করে। ধারাবাহিক এ সকল রোমহষর্ক ঘটনায় পল্লবীসহ গোটা মিরপুরে বেশ আতংক বিরাজ করছে।
এদিকে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকায় আন্তঃজেলা সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চোর চক্রের প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি চক্র সক্রিয় অবস্থান করছে। প্রতিটি চক্রে ১২-২০ জন সদস্য পরিকল্পিতভাবে ভিন্ন ভিন্ন অভিনব কায়দায় গাড়ি চুরি করছে। রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল, বৃহৎ মার্কেট, ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে এরা। এসব স্থানে কোনো গাড়ি কতক্ষণ পার্কিং-এ থাকে, গাড়ির নম্বর, চালক ও মালিককে অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহের পর পুরো চক্রটি গাড়ি চুরির পরিকল্পনা করে। সুযোগ বুঝে কাজ বাগিয়ে চম্পট দেয়। অনেক সময় খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ কিংবা বিশেষ নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে খাইয়ে চালককে অজ্ঞান করেও সিএনজি, অটোরিকশা চুরি করে এই চক্রগুলো।
সিএনজি চুরির কৌশল বিষয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সক্রিয় চোর চক্রের সদস্যরা আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন চায়ের দোকান, সিএনজি স্ট্যান্ড ও চুরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন এলাকায় আড্ডারত অবস্থায় থাকে। অনেক চায়ের দোকানদাররাও এই চক্রের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় ওইসব দোকানে কোনো সিএনজিচালক গাড়ি থামিয়ে চা খেতে গেলে চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে দেওয়া হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে চালক নেশায় ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা অসুস্থ বলে মানবিক কারণ দেখিয়ে জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চালককে সিএনজিতে তোলে। দূরে কোনো নির্জন স্থানে ফেলে রেখে সিএনজি নিয়ে উধাও হয়ে যায় চোরচক্রের সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় কিছু সোর্সেরও গাড়ি চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য রয়েছে জানায় গোয়েন্দা সূত্র।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, আমার থানা এলাকায় এ ধরনের কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক ও গোপনে তথ্য সংগ্রহসহ অভিযানে নেমেছে পল্লবী থানা পুলিশ। গত ৭ আগস্ট একটি চোর চক্র পল্লবী থানা এলাকায় সিএনজি ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আল-আমিন, ফরিদ হোসেন, হোসেন মিয়া, নাইম ও কামাল নামে সিএনজি চোর চক্রের পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তারা অপরাধের বিষয় স্বীকার করলে নিয়মিত মামলা করে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত আসামীগণের দেয়া তথ্য ও পুলিশের বিশ্বস্ত সোর্সদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তদন্তসহ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আশা করি পল্লবী থানাধীন এ ধরনের সকল অপরাধীচক্রকে দ্রুতই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হব।