ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এ অশ্রু বিজয়ের

নাহিদ হাসান রবিন
🕐 ৭:০১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০২২

এ অশ্রু বিজয়ের

ভালোবাসা নেই, ভালোবাসা কৃত্রিম এমন কথা আমাদের দেশের মানুষের কাছে অনেক পরিচিত। আসলে কি ভালোবাসা নেই? আছে, ভালোবাসা অবশ্যই আছে, ভালোবাসা থাকবে। আবার ভালো মানুষ নেই, এমন কথাও বলা যাবে না। হয়ত কম আছে। তবে ভালো মানুষ এবং ভালোবাসা দুটোই আছে। আজ এমন একজন ভালো মানুষের কথা বলছি। ভালোবাসা কাকে বলে, সমাজকে দেখাতে পেরেছে। যা থেকে আমাদের সমাজের অনেক কিছুই শেখার আছে।

খুবশিশু কাল না হলেও জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছে। অভাবের সংসারে একমাত্র সন্তান রাসেলকে মানুষ করার জন্য মা সাজেদা খাতুন একটা বিড়ির কারখানায় কাজ নেয়। সামান্য আয়ে সন্তানকে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা। এসব কারখানায় কাজ করা মহিলাদের নানা রকম কেলেঙ্কারি আমাদের সমাজে আছে। সাজেদা খাতুন স্বামীহারা হওয়ার পরেও এমন কলঙ্ক তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আবার বাবাহারা সন্তানরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বখাটে হয়ে যায়। রাসেল সেরকম কিছু হয়নি। অভাবের সংসারে জীবনের ঘানি টেনেও সাজেদা খাতুন ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছে। রাসেল যখন এসএসসি পাশ করে সাজেদা খাতুনের আনন্দের কোন সীমা ছিল না। ছেলে রাসেল কলেজে ভর্তি হয়ে মাকে আর কাজ করতে দেয়নি। ভোরবেলা থেকে আটটা-নয়টা পর্যন্ত খবরের কাগজ বিক্রি করে। তারপর বাড়িতে ফিরে নাওয়া খাওয়া সেরে কলেজে চলে যায়।

বিকালে আবার দু-চারজন ছেলে মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। মা সাজেদা খাতুন ছেলের এমন পরিশ্রম দেখে নিজে আবার কাজ করতে চায়। কিন্তু রাসেলের কথা- আমি যা পারি তাই খাওয়াবো। কিন্তু তোমাকে কাজ করতে দিবো না। ভালো মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার একটা রহমত থাকে বলেই, রাসেলের পরিবার ভালোভাবে চলতে থাকে। দুজন মানুষ খেয়ে পরেও জমানো কিছু টাকা দিয়ে একটা গাভি কেনে রাসেল। সাজেদা খাতুন বাড়িতে বসে গাভি দেখাশোনা করে। দুধ বিক্রির টাকায় ছয় মাসের মাথায় আরেকটা গাভি কিনে ফেলে রাসেল। খুব অল্প সময়েই অভাবকে তাড়িয়ে দেয়। ১৫-১৬ বছর বয়সি একটা ছেলে নিজের আয়ে সংসার চালিয়ে পড়ালেখা করা, খুব সহজ বিষয় না। যা রাসেল খুব অনায়াসেই করে যাচ্ছে।

পরিচয় হয় কাজুলী নামে এক মেয়ের সাথে। কাজুলী দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ির অবস্থা রাসেলদের চেয়ে কিছুটা ভালো। একসময় দুজনের সম্পর্ক ভালোবাসায় গড়ে যায়। এই বয়সে যা হবার আর কি। কাজুলী মেয়েটাও রাসেলের মতো নম্র-ভদ্র। এজন্যই হয়ত মিলেছে। তরুণ বয়স, দুজনের সম্পর্ক একেবারে গভীর হয়ে যায়। এক মুহূর্ত দুজন দুজনকে না দেখে থাকতে পারে না। এসব পাগলামিতে বিষয়টা এলাকায় জানজানি হয়ে যায়। কাজুলীর বাবা কড়া শাসনে রাখে কাজুলীকে। দুজনের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। কাজুলীর বাবার ভয়ে রাসেল আর ঐ এলাকায় যায় না।

কিন্তু কথায় আছে না, ভালোবাসা কোন বাঁধা মানে না। বাবা-মায়ের অনুগত দুজন তরুণ-তরুণী ভালোবাসার কাছে বাবা-মায়ের আদেশ ভুলে যায় বা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় সম্পর্ক চালিয়ে যায় ওরা। একদিন ঘটে যায় অন্য ঘটনা। পরিবারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দুজন পালিয়ে যায় বিয়ে করার জন্য। বাড়ি থেকে অনেক দূরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য রওনা হয়। সন্ধ্যার একটু আগে ওরা পদ্মা নদীর ঘাটে পৌছে। ওপারের চরে নেমে প্রায় তিন কিলো পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে সেই বাড়িতে। অর্থাৎ সেখানে পৌছিতে সন্ধ্যার পরেও দু-ঘন্টা পার হয়ে যাবে। নৌকায় অনেক যাত্রি আছে। হয়ত কোন অসুবিধা হবে না।

শরতের পূর্ণিমা রাত। দুর্গম চরে রাতে নৌকা থেকে নামার পর দুজন হাঁটতে থাকে। চোখে রঙিন স্বপ্ন। একটা নতুন জীবনে পা দিবে দুজন। এসব নানা ভাবনায় আনন্দ যেন ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। জনশূন্য চরের মেঠোপথ ধরে দুজন চলছে। কখনো মাঝে মাঝে ছোট ছোট কাশবন। পূর্ণিমা রাত হওয়ায় পথ চলতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের বিরতীহীন কথা হচ্ছে। অধিক আনন্দে দুজন হাত ধরাধরি করে পথ চলছে। খানিকটা পথ গিয়ে ঘটল অন্য ঘটনা। ভরা পূর্ণিমা মুহূর্তেই ঢেকে গেল ঘন অন্ধকারে। কয়েকজন লোক ওদের পথ রোধ করে।

রাসেলকে মারধর করে মুখ বেঁধে রেখে কাজুলীকে পাশের কাশবনে নিয়ে যায়। পালাক্রমে ওর নারীত্ব কেড়ে নেয় পাষণ্ডরা। কাজুলীর বাড়ি থেকে গোপনে আনা সামান্য কিছু গহনাপত্র ও নগদ টাকা-পয়সাসহ রাসেলের কাছে থাকা হাজার পাঁচেক টাকাও লুটে নিয়ে পালিয়ে যায় নরপশুর দল। ওদের চিৎকার-চেঁচামেচির পর দুজন পথচারী ওদের উদ্ধার করে রাতেই নৌকাযোগে উপজেলা হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসা অবস্থায় তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে পুলিশ হেফাজতে চলে যায়। পরদিন দুজনের অভিভাবক খবর পেয়ে থানায় গিয়ে মুচলেকা দিয়ে নিয়ে আসে।

কোরো শুভ বার্তা মানুষের মাঝে দেরিতে পৌঁছালেও, অশুভ বার্তা পৌঁছে বাতাসের আগে। কাজুলী আর রাসেলের এই অশুভ বার্তাও বাতাসের সাথে পৌঁছে যায় এলাকায়। বাড়িতে আসার আগেই দুজনের এলাকায় গুঞ্জন ছড়ে। কাজুলীর পরিবার বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সমালোচনা এখন তুঙ্গে। লজ্জায় বাড়ির বের হয় না পরিবারের কেউ। অন্যদিকে রাসেলের বাবাহীন পরিবারে ভাত-কাপড় দেওয়ার লোক না থাকলেও, খবরদারি করার লোকের অভাব নেই। রাসেলের ছোট চাচার গরমে বাড়িতে থাকাই দায় হয়ে যায়, বিধবা মা আর রাসেলের।

ছেলেটাকে বেধড়ক মারপির করেছে ওর চাচা। কিশোর মনে এত বড় একটা ধাক্কা লাগার পরে, শারীরিক এমন নির্যাতনে ছেলেটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রতিবেশিদের সহযোগিতায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে রাসেল বাড়ি ফেরে। এর মধ্যে কাজুলীর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। রাসেলের মন পড়ে আছে কাজুলীর কাছে। চাচাদের ভয়ে রাসেল নতুন করে কাজুলীর সাথে যোগাযোগ করতে সাহস পায় না। এদিকে বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত অনেকের নানা কথায় রাসেল জড় পদার্থের মতো হয়ে যায়। গতকাল এক বন্ধু তো বলেই ফেলেছে- এমন ঘটনার পরে একটা কলঙ্কিত নারীকে নিয়ে এত ভাবনার কি আছে। কিন্তু রাসেল কাজুলীকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে চায় না।

কাজুলীর অসহায় বাবা স্থানীয় লোকজনসহ চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে রাসেলের পরিবারের লোকজনের সাথে বিয়ের আলোচনায় বসে। রাসেলের চাচা এতে কোনভাবেই রাজী না। রাসেলের মা পরিবারের লোকজনের ভয়ে কিছু বলে না। কিন্তু কথায় আছে না, প্রয়োজনের তাগিদে দুর্বলরাও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাসেলও তার চাচাদের এমন আচরণে নিজেকে শক্ত করে তোলে। সবার সামনে রাসেল বলে দেয়, কাজুলী কোনো নষ্টা মেয়ে নয়। আমাকে ভালোবেসে কাজুলী আমার হাত ধরে বের হয়েছিল। ওকে আমি রক্ষা করতে পারিনি। এদোষ আমার। আমার কারণে নারীত্ব হারানো একটি মেয়েকে আমি ফেলে দিতে পারি না। আমি সবাইকে ছাড়তে পারলেও, কাজুলীকে ছাড়তে পারব না।

সারাজীবন কলঙ্কের বোঝা বহন করতেও আমি রাজী। আমি কাজুলীকেই বিয়ে করব। রাসেলের এমন কথায় চেয়ারম্যান সাহেব ও স্থানীয় লোকজন বাহবা দেয়। ছেলের এমন সাহস দেখে মায়ের মুখেও আনন্দের ঝিলিক। কেননা সেও একজন নারী। রাসেলের চাচা সবার চাপে মাথা নিচু করে চলে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত থেকে একজন মাওলানা ও কাজি ডেকে বিয়ে সম্পন্ন করেন। সকল সমলোচনা আর নিন্দাকে উপেক্ষা করে একজন সম্ভবহারা নারীকে বউ করে রাসেল। অজান্তেই রাসেলের দুচোখ বেয়ে ক’ফোটা অশ্রু গড়ে পড়ে। এ অশ্রু, কোনো বেদনার নয়, এ অশ্রু জীবন যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার অশ্রু।

 
Electronic Paper