হিরো আলমের যত দোষ
ইমরান মাহফুজ
🕐 ৫:৩৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০১, ২০২২
বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে রবীন্দ্র সংগীতসহ বিভিন্ন সংগীত বিকৃতি, বিনা অনুমতিতে পুলিশ কনস্টেবলের পোশাক পরে ডিআইজির ভূমিকায় অভিনয় এবং ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগে হিরো আলমকে ডাকা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি মুচলেকা দিয়ে বলেছেন যে, তিনি ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আর করবেন না। তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে।
এই ঘটনা গত ২৭ জুলাই বুধবারের। বাংলাদেশের মতো সমস্যাবহুল দেশে- এটা একটা ছোট ঘটনা হয়তো কিন্তু এর মাধ্যমে একজন নাগরিকের জন্য অশুভ সঙ্কেত। সভ্য সমাজে একজন নাগরিকের জন্য এই মুচলেকা একেবারে অপ্রত্যাশিত। ‘সুশীল-শিক্ষিত’ ও ‘অপেক্ষাকৃত সচ্ছল’, ‘শ্রেণি সচেতন’ নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া কোন দিকে হয় সেই অপেক্ষায় ‘আম’ হিরো আলম!
২৯ জুলাই দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হিরো আলম বলেন, ‘তারা যখন জেলের কথা বলে তখন আমি বলি, ভবিষ্যতে এমন গান করব না এবং পুলিশের পোশাক পরে আর কাজ করব না। তারা বলে, তুই তাহলে বিপাশা, মৌ তাদের কাছে ভিডিওতে মাফ চা। ভবিষ্যতে তুই এমন কাজ করবি না তার প্রমাণ কী? তাহলে তুই মুচলেকা দে। আমি মুচলেকা দিতে চাইনি। তারা জোর করে আমার থেকে মুচলেকা নিয়েছে।’
দায়িত্বশীল পুলিশের দায়িত্বশীল আচরণ। এর মাধ্যমে পুলিশের চরিত্রও পরিষ্কার হয়। নাটকে পুলিশের পোশাক ব্যবহারে পুলিশ তার মুচলেকা নিতে পারে হয়তো। কিন্তু পুলিশ রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত গাওয়া বন্ধে মুচলেকা নিতে পারে কী? সে দায়িত্ব তারা কীভাবে পেল? (দেশে কতজন ভালোভাবে, নিয়ম মেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়? সে হিসাব কার কাছে- প্রশ্ন থেকে যায়) মুচলেকা নেওয়ার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, কে জবাব দিবে! তার আগেও হিরো আলমের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কথা উঠলে তার যুক্তি ছিল, তিনি গাইতে ভালবাসেন। তার গান অনুরাগীরা ভালবাসেন। তাই গান প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, সঙ্গীত নিয়ে সবার আপত্তি মেনে নিয়েছি। তার পরেও সেই গান ছড়িয়ে পড়ার পিছনে আমার হাত নেই।’’ সত্যি কারা তার গান শোনে, কারা শেয়ার করে, কীভাবে হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছায়?
দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন হিরো আলম জানান, ‘ওরা আমাকে বললেই আমি ডিবি অফিসে যেতাম। এভাবে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? তারা বুঝাতে চেয়েছে আমি আপসে গেছি। কিন্তু আমি তো আপসে যাইনি। আমাকে তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। লোক দেখানোর জন্য তারা নিজেরাই আমার হেঁটে যাওয়ার ভিডিও করে। হেঁটে যাওয়ার ভিডিওটি দুপুর ১টার দিকের। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করার পর যখন আমি চলে আসব, ঠিক তার কিছুক্ষণ আগে তারা সেই ভিডিও ধারণ করে।’
ডিবি অফিসের ৮ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হিরো আলম বলেন, ‘সকালে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করে। সকালে আমাকে বলে, খাবার খা। আমি যখন বলি খাব না, তখন তারা আবার খারাপ ব্যবহার শুরু করে। বলে, খাবি না কেন? আমার সামনে খা। তোর কোনো কথা চলবে না। আমরা যা বলি তাই চলবে।’
পুলিশের এই আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। না মেনেও আমরা কী করতে পারব। সে সমাজে কথা না বলায় নিরাপদ মনে করা হয়। কিছুদিন আগে হিরো আলম গান প্রসঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করে সমাজের কাছে, ‘‘একা হিরো আলম সঙ্গীতের সর্বনাশ করছে? আর কেউ বাংলা গানের বারোটা বাজাচ্ছেন না? যত দোষ একা আমার!’’ সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর কি কি ক্ষতি করেছে? প্রাত্যহিক জীবনে আপনার আমার কতটা বাধাগ্রস্ত করেছে?
যৌক্তিক প্রশ্ন। উত্তর কে দিবে, কেউ নেই কোথাও! অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে হিরো আলমের ক্ষোভ, তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। গায়ের রং কালো। এই নিয়েও নাকি বহু জনের আপত্তি। তার বিরুদ্ধে অকারণে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। হিরো আলমের আফসোস, এগুলোর কোনওটায় তার হাত নেই। একই সঙ্গে দাবি, মানুষ না ভালবাসুক, ঈশ্বর তাকে ভালবাসেন।
কথাগুলো মানবিক যে কেউ শুনলে খারাপ লাগার কথা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত একবার বলেছিলেন, ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে। সাধিতে মনের সাদ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করো না গো।’ অর্থাৎ একজন কবির টিকে থাকার আকুল আগ্রহ। অমরত্বের স্বাদ নিতে কবিরা এমনি। অথচ, ধুলোকাদা থেকে উঠে আসা এক আলাভোলা গেঁয়ো উচ্চারণে কবির গান গাইতে চেষ্টা করছে। এতে আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। খুশি হয়ে হিরো আলমের পিঠ চাপড়ে দিতেন। বলতেন 'কাঠের শহুরে প্রাণহীন শিল্পীর চেয়ে তুমি আমার মাটিমাখা আরাম।
২০২০ একুশে বইমেলায় ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান আমরা সমাজকে বদলে দেব’ এই নামে বই লিখেছেন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। প্রচ্ছদে লিখেছেন, বিখ্যাত হতে আসিনি, শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চেয়েছি। ভেতরে তিনি বলেন, আমাকে নিয়ে সবাই অনেক হাসিঠাট্টা করেন, ট্রল করেন; কিন্তু পর্দার ওপারে হিরো আলমকে কয়জন চেনেন? এই বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারবেন আমার জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে। কয়জন তাকে জানেন?
খ
আমি প্রায় দেখি হিরো আলমকে নিয়ে প্রকাশিত নিউজ, ভিডিও’র নিচে কমেন্টে আসে ‘তুই কে রে’, ‘তোরে কী এটা মানায়’, ‘আনস্মার্ট’, ‘অশিক্ষিত, খ্যাত’, ‘গরীব’ ‘ফকিন্নির পুত তোরে সামনে পাইলে খাইয়া পালামু’ ‘মুর্খ একটা কোনানকার’, ‘তারে কেউ গুলি করে না ক্যান’ এমন অশ্রাব্য বাক্য।
পুলিশের আচরণের চেয়ে কম না। হিরো আলমের পক্ষে বা বিপক্ষে আমি নই। কিন্তু একজন নাগরিকের অধিকার নিয়ে কথা বলছি। পুলিশ তার সঙ্গে কী আচরণ করেছে? ভুলে যাবেন না, আপনার আমার মতো হিরো আলমও সমাজের একজন নাগরিক। ভোটের বাজারে একজন ভোটার। অহেতুক তাকে নিয়ে আমরা বুলিং করতে ছাড়ছি না, যা অমানবিক, নিদারুণ। তাকে নিয়ে এতো হিংসা, কেন? গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন, গাঁয়ের আচরণ?
খেয়াল করলে দেখবেন, এখানে মানুষ নিজে ভালো কাপড় পরলে অন্যের খারাপ কাপড় দেখে বাঁকাচোখে তাকায়। একটু শিক্ষিত হলে সবাইকে অশিক্ষিত হিসেব করে কথা বলে। কোনো রকম একটা ভালো গাড়িতে চড়ে বসলে বাকিদের রাস্তায় থাকা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। এইধরনের নানান উদাহরণ আছে চারপাশে। বড় অস্থির উপরতলার জীবন! সুযোগ পেলেই দৃশ্য অদৃশ্যে আঘাত করতে ভুল করে না। একটি সমাজে এইভাবে টিকে থাকা কঠিন। হতাশা ভর করে...
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্য ছিলো হ্রদয়-বিদারক। বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামো, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উচ্চতা তথা বর্গের ব্যবধান। এইভাবে সামাজিক-সংস্কৃতি নির্যাতন পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মনস্তাত্বিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছে বাঙালিদের এবং এর মধ্যে দিনে দিনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্ত হয়েছে। এসেছে জনকের হাত ধরে স্বাধীনতা। আবার সেই স্বাধীন দেশেও জাতির জনক বৈষম্য, অসমতা দূর করার সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন সারাজীবন। বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপ দিতে তার প্রচেষ্টাকে আজকে আমরা কী করছি?
গ
ধরে নিলাম আপনি একজন প্রতিক্রিয়াশীল। কোনো বিষয়ে দেখলে আপনি প্রতিক্রিয়া না করে থাকতে পারেন না। নেপাল ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনার পর ব্যাপক সমালোচনা হয় সারাদেশে। যে জীবনে একবার প্লেনে উঠে নাই, সেও অসাধারণ অভিজ্ঞতায় বয়ান করেছেন ফেসবুকে। ধুয়ে দিয়েছে পাইলটকে!
ভাগ্যিস পাইলট মারা গেছেন। না হলে আমাদের হাতেই মারা পরতো। কিন্তু পরের মাসে মায়ানমারে ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দরে অবতরণকালে বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে রানওয়ে থেকে বাইরে চলে যায় বিমান। কিন্তু একজন মানুষও মারা যায়নি। যাত্রীরা জানায় পাইলটের দক্ষতার কারণে বেঁচে গেছেন তারা। এই অসাধারণ কাজের জন্য তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন? পোস্ট দিয়ে মতামত জানিয়েছেন? দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ, চারপাশের চাটুকার ও তেলবাজ, অসহায় মানুষের অর্থ আত্মসাৎকারী আছে, তাদের নিয়ে কয়জন কথা বলেন?
অথচ হিরো আলমকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মজা করেন। সমাজে সস্তা বিষয় আগ্রহ আমাদের। ফরজ নামাজ না পড়ে মিষ্টি খাওয়া সুন্নতের মতো ব্যস্ত সবাই। অথচ হিরো আলম চাটুকারি, তেলবাজি,দলবাজি করে জায়গা নিয়ে আরেকজনের সুযোগ নষ্ট করছে না। নিজের কাজ নিজের খেয়ালে করছে। সবাই সব গুণ, মেধা পায় না- এটাই কেন মেনে নিতে কষ্ট হয়?
প্রশংসার যুগে দেশের নানামাত্রিক সঙ্কটে সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী কয়জন কথা বলে? দেখা যায় না, তবে ফেসবুকে দুই একজন হায় হুতাশ করে। ঠিকঠাক জায়গায় কথা বলতে ভয় পান, এই ভয় সুযোগ হারানোর ভয়। সমাজের অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলার সৎসাহস নেই। কারো কাজ কারো ভালো না লাগলে এড়িয়ে যাবার সুযোগ আছে। তা কেন করি না। প্রতিক্রিয়া কেবল বেড়ালের মতো মিউমিউতে!
মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজ্জার একটা গল্প দিয়ে শেষ করি : হোজ্জার গাঁয়ের যিনি মোড়ল, তিনি একটা কবিতা লিখেছেন। হোজ্জাকে তিনি সেটা পড়ে শোনালেন। নিজের লেখা সম্পর্কে বেশ উঁচু ধারণা পোষণ করেন মোড়ল সাহেব। গদগদ কণ্ঠে হোজ্জার কাছে জানতে চান, তা, আমার কবিতাটা কেমন লাগল? বেশ ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই।
হোজ্জা দেখতে গম্ভীর। তিনি সোজাসাপটা জবাব দেন, নাহ, মোটেও ভালো লাগেনি আমার। পঁচা কবিতা। এ কথা শুনে মোড়ল বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। রাগের চোটে গা জ্বলে যাচ্ছে তাঁর। কড়া শাস্তি দিলেন হোজ্জাকে। টানা তিনদিন জেলে বন্দি থাকতে হলো তাঁকে। পরের সপ্তাহের ঘটনা। মোড়ল হোজ্জাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর দপ্তরে। নতুন একটা কবিতা লিখেছেন তিনি।
সেটা বেশ ঘটা করে পড়ে শোনালেন। হোজ্জার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন মোড়ল, কী, এই কবিতাটা কেমন লিখেছি? এই কবিতা সম্পর্কে এখন আপনি কী বলবেন?
নাসিরুদ্দীন হোজ্জা নির্বিকার। তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। মোড়লের কথা শোনার কয়েক সেকেন্ড পর তিনি হাঁটা ধরলেন। মোড়ল অবাক! জানতে চাইলেন, আরে, আরে! কী ব্যাপার? হোজ্জা, আপনি যাচ্ছেন কোথায়? জেলে। হোজ্জার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
গল্পটা সময়ের সাথে মিলাতে পারেন, তবে জেলে যেতে হবে না। রাষ্ট্র সমাজপতিদের কতকিছু আছে অপছন্দের , আমাদের ভালো লাগে না- গ্রহণ করার মতো না- সেই ক্ষেত্রে কী করি? কেবলমাত্র হিরো আলম আমাদের মাথা ব্যথা। আমি মনে করি, হিরো আলম চেয়ে চারপাশের বহুবিষয়, বহু সঙ্কট আছে কথা বলার, আলোচনা করে সমাধান করার, তা নিয়েই আলাপ করি। যেদেশের মৌলিক চাহিদাও এখনো মিটেনি, তাদের কত হম্বিতম্বি! সভ্য সমাজ হলে তা ভেবেই লজ্জা লাগার কথা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। দ্য ডেইলি স্টারে কর্মরত