ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সম্ভব না থেকে সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৬, ২০২২

সম্ভব না থেকে সম্ভাবনা

কীর্তিনাশা পদ্মা ক্রমবর্ধমান ধেয়ে চলা যার বৈশিষ্ট্য।

কেড়ে নেওয়া ও নির্মমতা যার স্বভাব। কতশত মানুষের স্বপ্ন ও শেষ আশ্রয়স্থল গ্রাস করেছে এই পদ্মা তার কোনও হিসাব নেই। এবার এই পদ্মার বুক চিরে জ্বলে উঠেছে আলো। না এখন আর পদ্মা কীর্তিনাশা নয়, পদ্মা এখন কীর্তিমান। পদ্মার বুকে জেগে উঠা ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন আজ বাস্তব। বুক ফুলিয়ে এখন দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। পদ্মার বুক চিরে দৃশ্যমান হয়েছে দীর্ঘ ৬.১৫ কিলোমিটার সেতু। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের এক চোখ ধাঁধানো স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু দেশের মানুষের গর্ব। দেশের প্রতিটি মেহনতি মানুষের ঘাম লেগে আছে এই সেতুতে। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই সেতু। তাই তো আজ আমরা গর্ব করে বলতেই পারি আমার টাকায় আমার সেতু। একজন তরুণ হিসেবে বাংলাদেশের এই মাহেন্দ্রক্ষনের সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত।

একটি পদ্মা সেতু কি তা অনেক আবেগী মানুষ না বুঝলেও বোঝেন মৃত্যুসঞ্জায় কাতরানো অসহায় রোগীর স্বজনরা। যারা ঘন্টার পর ঘন্টা নদী পার হওয়ার জন্য বসে থাকতো ফেরি ঘাটে। কত মানুষের প্রাণ গেলো সঠিক সময়ে রোগীকে রাজধানী ঢাকার হাসপাতালে না আনতে পেরে। পদ্মা সেতু কি তারা বুঝেন যারা মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে ছুটি যেতে পারেনি সময়মত। আহা কত মানুষ শেষ দেখাও দেখতে পারতো না স্বজনদের। ঈদে বাড়ী ফেরার জন্য কতই না ভোগান্তি পোহাতে হত। আমার বন্ধু সজিবের সাথে দেদিন কথা হলো পদ্মাসেতু নিয়ে তার অনুভুতি নিয়ে। তার বাড়ী ফরিদপুর। সেতুকে ঘিরে অবশ্যই তার আনন্দটা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কান্না জড়িত কন্ঠে সে বলল,‘ বন্ধু সেতুটা যদি ২০১৭ সালে হতো হয়তো আমার বাবাকে হারাতাম না’। পরে তার কাছে জানলাম, ২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত (ব্রেন স্ট্রোক) কারণে বাবাকে হারান। ঢাকা মেডিকেলে আনার পর ডাক্তার বলেছিলো ‘আরেকটু আগে আসলে হয়তো রোগীকে বাঁচানো যেত’। সজিব বলেন ওই কথাগুলো মনে হলে এখনও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তবে স্রোতস্বিনী পদ্মার ওপর একটু ক্ষোভ থাকলেও এখন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে সজিব। কারণ, তার মতো আর কাউকে প্রিয়জনকে হারাতে হবে না। চোখের সামনে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে হবে না কোনো রোগীকে। আগে যেখানে পদ্মা পার হতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগত, এখন মাত্র ছয় থেকে আট মিনিটে পার হওয়া যাবে প্রমত্ত পদ্মা।

এই সেতু যে শুধুমাত্র মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজে পৌঁছেছে তা কিন্তু নয়, এই পদ্মা সেতু দ্বার উন্মোচন করছে অর্থনীতিতে। যার মাধ্যমে ভাগ্য বদলে যাবে পদ্মার পাড়ের মানুষের। পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক। পদ্মাসেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে।

পদ্মা নদীর মাওয়া পয়েন্টে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ফরিদপুর জেলাগুলোর উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করবে যা বিস্তৃত হবে খুলনা ও সাতক্ষীরা পর্যন্ত। দেশের দক্ষিণে বসবাসরত জনজীবনের জীবনমান উন্নয়নসহ স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও বাজার সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহের সুযোগ তৈরি ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে পদ্মা সেতু। সেতুটির কারণে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা চট্টগ্রাম বন্দরের মতো যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এই সেতুটি শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুবিধা হবে।

এ ছাড়া দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটির কাজ সমাপ্ত হলে অতিরিক্ত ১.২৩ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সেতুটি যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত হলেই দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারি শিল্পকারখানা।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মাপারে হচ্ছে তাঁতপল্লী ও আইটি পার্কও। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইটি পার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিবচরের কুতুবপুরের কেশবপুরে ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি এ্যান্ড হাইটেক পার্ক’ নির্মাণে ৭০ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। এর বাইরে আরও অনেক ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।

পদ্মাসেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে।

করোনার ভয়াল থামাকে পাশ কাটিয়ে মাত্র ৮ বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের সামনে পদ্মা সেতুকে বাস্তবরূপে দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সত্যি এমন একটি দুরদর্শী নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদ্মাসেতু বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন তার জন্য কৃতিত্বের দাবীদার।

তবে আজকের এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন মোটেও সহজতর ছিলো না। অনেক হোঁচট খেতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। ২০১২ সালে যখন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরও তিনটি সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতে পদ্মার আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। যা আজ স্বপ্ন থেকে বাস্তব।

আজ আমরা এমন একটি সেতু উপহার হিসেবে পেয়েছি যে সেতুটি মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি। যা পৃথিবীতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদীশাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। অবশেষে খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হয়েছে স্বপ্নের এ সেতু।

পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদা, দৃঢ়তা ও অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার প্রতীক। সব অসত্য ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সততা, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার কাছে পরাজিত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার অন্যতম সাক্ষী এই পদ্মা সেতু। যতদিন পদ্মা সেতু থাকবে, ততদিন ইতিহাসের পাতা থেকে শেখ হাসিনার নাম কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। বিশ্বকে শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন- বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না, পারেওনি, পারবেও না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই দেশকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন । আর আজ তারই উত্তরসূরি হিসেবে তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করে দেশের মানুষসহ সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ ঠিক বর্তমান সময়ে এসে আমরা তরুণ প্রজন্ম গর্বের সাথে বলতে পারি,‘ আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, তবে আমি শেখ হাসিনাকে দেখেছি। যিনি সকল ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে জানেন।

লেখক: মো.শাহাদাত হোসেন নিশাদ

 
Electronic Paper