ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ক্যান্সারে আটটি বিকিরণ যন্ত্রের পাঁচটিই নষ্ট

প্রীতম সাহা সুদীপ ও সাহেদুজ্জামান সাকিব
🕐 ৩:৩৮ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২২

ক্যান্সারে আটটি বিকিরণ যন্ত্রের পাঁচটিই নষ্ট

দেশে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গবেষকরা বলছেন, যে হারে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বাড়ছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। প্রাণঘাতী এই রোগের চিকিৎসায় যে পরিমাণ হাসপাতাল ও বিকিরণ যন্ত্র দরকার, দেশে তার অর্ধেকও নেই। আর যেসব যন্ত্রাংশ রয়েছে তার অধিকাংশই নষ্ট বা অকার্যকর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯৬ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বাংলাদেশে এখন ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী আছেন। প্রতি বছর নতুন করে এখানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার এবং মারা যায় ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ। সংস্থাটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এসব কেন্দ্রে ক্যান্সার শনাক্তসহ ক্যান্সার চিকিৎসার তিন ধরনের (কেমোথেরাপি, সার্জারি ও বিকিরণ চিকিৎসা) পদ্ধতি থাকতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী এ দেশে ১৭০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার।

অথচ সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, দেশে ক্যান্সার কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে বিকিরণ যন্ত্র আছে ১৯টিতে। আর ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশে কমপক্ষে ২২০টি বিকিরণ যন্ত্র দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ৫৭টি যন্ত্র। এর মধ্যে চালু আছে ৪৩টি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন বেশি মানুষকে বিকিরণ চিকিৎসা দিচ্ছে, তবে এর জন্য রোগীদের প্রচুর খরচ বহন করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের গরিব ক্যান্সার রোগীদের একমাত্র ভরসা জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে হতাশ বেশিরভাগ রোগীই। যেখানে সেখানে ময়লার খোলা ড্রাম ও বিকল পানি পরিশোধন যন্ত্র। টাকা না দিলে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল না পাওয়াসহ নানান অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন তারা।

দিনাজপুর থেকে চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছেন মিজানুর রহমান। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখানে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আমরা গরিব মানুষ। ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রাইভেট হাসপাতালে অনেক খরচ তাই চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এখানে কোনো মেশিনপত্র ঠিক নেই। বেশিরভাগ পরীক্ষার জন্যই যেতে হয় বাইরের হাসপাতালগুলোতে। এতে আমাদের খরচও বেশি হয় আর অসুস্থ অবস্থায় অন্য জায়গায় যেতে প্রচুর কষ্ট হয়।

আইসিইউতে থাকা স্বামীর জন্য গত পাঁচ দিন ধরে এই হাসপাতালে আছেন নমিতা রানী সরকার। তিনি বলেন, গরিবের সঙ্গে গরিবের মতো আচরণই করা হয়। এখানে যাচ্ছেতাই পরিবেশ। একজন সুস্থ মানুষও এই পরিবেশে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। অন্ধকারে বসে থাকি, প্রচুর মশা আর দুর্গন্ধ। হাসপাতালে যদি আলো না থাকে তাহলে আমরা বসবো কোথায়? এখানে বসে থাকা যায় কীভাবে? ওয়াশরুমগুলোতে যাওয়া যায় না এত খারাপ অবস্থা। ছোট থেকে ছোট পরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে হয়। রোগী নিয়ে টানাহেঁচড়া করা কতটা যে কষ্টের সেটা কীভাবে বোঝাবো। আর বাইরে পরীক্ষা করাতে টাকাও বেশি নেয়।

ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, হাসপাতালের বাথরুমগুলোতে যেতে হয় নাক চেপে। সিঁড়ির ওপরে পানের পিক, প্লাস্টিকের বোতল, কয়েক দিনের বাসি খাবার পড়ে থাকে এখানে-ওখানে, মেডিকেল বর্জ্যগুলো দিনের পর দিন পড়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই! পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দৌরাত্ম্যে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না রোগী ও স্বজনরা।

হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি খোলা জায়গায় রয়েছে ময়লা রাখার ডাস্টবিন। ড্রামগুলোর ভিতরে মেডিকেল বর্জ্য, যেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে জীবাণু। ক্যান্সার হাসপাতালের মতো এতো স্পর্শকাতর জায়গায় এভাবে ময়লার ড্রাম রাখায় হতবাক গোপালগঞ্জ থেকে ছেলেকে নিয়ে আসা এক মা। তিনি বলেন, ফ্লোরে কিছু পড়ে গেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ডেকেও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে নিজেরা ফ্লোর পরিষ্কার করি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ওয়ার্ডগুলোতে ঝাড়– রেখে কোনো না কোনো বাহানায় চলে যায়। শেষে বাধ্য হয়ে আমরাই কেউ না কেউ ঝাড়– দিই।

শুধু তাই নয়, হাসপাতালে টাকা না দিলে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল পাওয়া যায় না বলেও তাদেরই কয়েকজন স্বজনের অভিযোগ। নাসিমা বেগম নামে এক মহিলা বলেন, স্বামীর রক্ত পরীক্ষার তারিখ ছিল, কিন্তু এখানে সিরিয়াল না পাওয়ায় হাসপাতালের একজন খালা (আয়া) তাকে নিয়ে যান রাস্তার ওপারের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। সেখানে ৯০০ টাকা খরচ করে তিনি পরীক্ষা করিয়েছেন।

এদিকে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতে ডানে রাস্তার পাশে যেখানে দু-চারটি গাড়ি থাকত, সেখানে এখন রোগী। তারা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। ঢাকা শহরে তাদের স্বজন নেই, হোটেলে থাকার আর্থিক সামর্থ্য নেই। হাসপাতালের পাশে ছোট এক কক্ষের বাসা ভাড়া নেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তারা এসেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে। বিছানা-কাঁথা-কম্বল-থালা-বালতি নিয়ে তারা গাড়ি রাখার জায়গায় থাকছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিকিরণ দেওয়ার জন্য লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র আছে চারটি। এর মধ্যে তিনটিই অকেজো। ২০০৯ সালের ১১ আগস্ট তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এই প্রতিষ্ঠানটির প্রথম রেডিওথেরাপির অত্যাধুনিক মেশিন লিনিয়ার এক্সিলারেটরের উদ্বোধন করেছিলেন। আর ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই এই হাসপাতালে সর্বশেষ লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র বসানো হয়, যার উদ্বোধন করেন সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে দুটি কোবাল্ট যন্ত্র রয়েছে, যার একটি নষ্ট। ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্র আছে দুটি, এর মধ্যে একটি নষ্ট। অর্থাৎ হাসপাতালের বিকিরণ দেওয়ার আটটি যন্ত্রের পাঁচটি নষ্ট।

এসব বিষয়ে কথা বলতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কক্ষে যান এই প্রতিবেদক। সাক্ষাৎকারের বিষয় বলার পর পরিচালক বলেন, আমার জরুরি মিটিং আছে, আপনারা আমার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। পরবর্তীতে তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কথা বলার এখতিয়ার নেই।

যন্ত্র চালানোর লোকও নেই লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র চালান মেডিকেল পদার্থবিদরা। হাসপাতালে এদের পদ আছে পাঁচটি। এসব পদে কোনো লোক নেই। যন্ত্র চালান যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোক। দুটি বেসরকারি হাসপাতাল জানিয়েছে, একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র দিয়ে তারা দিনে ৭০ থেকে ৯০ জনকে বিকিরণ থেরাপি দেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্যান্সার যাতে না হয় সে জন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে, মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ধূমপান পরিহার করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে রোগীদের সেবার পরিধি আরও বৃদ্ধি করা হবে। প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি, উন্নত প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করাসহ বিশ্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবার সব অগ্রগতিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সেবার সঙ্গে সংযোজন করা হবে।

ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ হুমায়ুন কবির বলেন, ক্যান্সার মারাত্মক রোগ, সময়মতো এর চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রতিবছর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। আমাদের দেশে ক্যান্সার ও এ রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থাও বিবেচ্য।

তিনি জানান, ক্যান্সার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এটা কী ধরনের রোগ, কী কী কারণে ঝুঁকি বাড়ে, প্রতিরোধের জন্য কী কী করণীয় সে বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। ক্যান্সার যেন না হয় সে জন্য মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ক্যান্সার প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব দেওয়া এবং ধূমপান পরিহার করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোসহ নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

 
Electronic Paper