ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আবারো নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০২২

আবারো নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন

সয়াবিন তেলের বাড়তি দামের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বোঝা কাঁধে নিতে হচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষকে। যতই দিন যাচ্ছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির তালিকা যেন আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে। তেলের পর এরই মধ্যে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিম ও গুঁড়া দুধের দাম। এর আগে রমজান মাসের শুরুতেই বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছিল। পুরো রোজার মাস বাড়তি দামের বোঝা টেনেছেন ভোক্তারা।

ঈদের আগে হঠাৎই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন। সরকারি হুঁশিয়ারি, প্রশাসনের অভিযান কিছুতেই যেন বাজারের পাগলা ঘোড়ায় লাগাম পরানো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে রয়েছে ভোক্তা সাধারণ। রোজার ঈদ শেষ হতে না হতেই ৫ মে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮-৪৪ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। সয়াবিন তেলের বাজার এখনও অস্বাভাবিক, এর মধ্যেই দাম বাড়তে শুরু করেছে অন্যান্য পণ্যের। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি করা প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম সামনে আরও বাড়তে পারে।

এক সপ্তাহে ১৫ খাদ্যপণ্যের ১.৫ থেকে ৩৮% মূল্যবৃদ্ধি : সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, গরুর মাংস, মুরগি ও ডিম এই ১৫টি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এসব পণ্যের দাম সর্বনিম্ন দেড় শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছেই : পেঁয়াজের মোকামে নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। চাষিদের সুরক্ষা দিতে আপাতত নতুন করে এই নিত্যপণ্যটি আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

মজুদে টান না পড়লেও কয়েকদিন ধরে দেশি পেঁয়াজের পাইকারি ও খুচরা বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে খুচরাতে একেক জায়গায় একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। বিষয়টি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের নজরেও এসেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আমদানি বন্ধের ঘোষণার পর থেকে দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বড় বাজারগুলোতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। আর পাড়া-মহল্লায় দাম রাখা হচ্ছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। অথচ সপ্তাহের শুরুতেও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৩৫ টাকা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল শুক্রবার প্রতি পাল্লা (পাঁচ কেজি) দেশি পেঁয়াজ পাইকারিতে ২১০ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি পাল্লা ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৮ টাকায় বিক্রি করেছেন দোকানিরা।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দেশের খুচরা ও পাইকারি উভয় বাজারে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-উর-রসিদ বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দেওয়া অনুমতির মেয়াদ গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল। পরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তা ৫ মে পর্যন্ত বাড়ায়। এরপর নতুন করে আর পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমদানির অনুমতি দিলে বাজার আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ডালের বাজারেও আগুন : গত দুই দিনে দাম বেড়েছে ডালেরও। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মোটা দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। আর সরু দানা মসুর ডালের কেজি এখন ১৩০ টাকা। ঈদের আগে দাম ছিল ১২০ টাকা।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোটা দানার মসুর ডাল আসে বিদেশ থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আগের চেয়ে বেশি দামে ডাল কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বাজারে দেশি ডালের সরবরাহ কিছুটা কম। তাই দাম বেশি। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি মসুর ডালের সরবরাহে ঘাটতি নেই। যেহেতু বিদেশ থেকে আমদানি করা ডালের দাম বেড়েছে, তাই সুযোগ বুঝে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করেই দেশি মসুর ডালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

গুঁড়া দুধের দাম সামনে আরও বাড়বে : বিভিন্ন মুদিপণ্যের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, কোম্পানিভেদে মোড়কজাত গুঁড়া দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬৯০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি। দোকানিরা বলছেন, যেসব কোম্পানির গুঁড়া দুধের মোড়কের গায়ে এখন ৬৯০ টাকা লেখা আছে, মাসখানেক আগেও এর দাম ৬৫০ টাকা ছিল। আর ৭৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া এক কেজি গুঁড়া দুধের দাম মাসখানেক আগে ছিল ৬৯০-৭০০ টাকা।

একটি গুঁড়া দুধ সরবরাহকারী কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর) বলেন, কোম্পানি থেকে তাদের শুধু বলা হয়েছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি পর্যায়ে ক্রয়মূল্য বেশি পড়ছে। এ কারণেই দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে সর্বশেষ তাদের কোম্পানির গুঁড়া দুধের দাম খুচরা বিক্রয়মূল্য (এমআরপি) ৭৯০ টাকা নির্ধারণ করেছে। অবশ্য ওই সব প্যাকেট এখনো বাজারে সরবরাহ করা হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, সামনে গুঁড়া দুধের দাম আরও বাড়বে।

ডিমের দাম হালি ৪০ : বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। আর এক ডজন কিনলে দাম রাখা হচ্ছে ১১৫ টাকা। অথচ গত সপ্তাহেও প্রতি হালি ৩৬ টাকা ও প্রতি ডজন ১০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগে গত ১০ এপ্রিল প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ছিল ৩২-৩৫ টাকা। আর গত বছরের এপ্রিল মাসে ডিমের দাম ছিল ২৮-৩০ টাকা। এক বছরে ডিমের দাম হালিতে বেড়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ।

বেড়েছে মুরগির দামও : বাজারে বেড়েছে মুরগির দামও। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায়।

মুরগি বিক্রেতা মো. রুবেল বলেন, মুরগির খাবারের দাম বাড়ায় খামারিরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে গত তিন-চার দিনের বৃষ্টি। এছাড়া রয়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব। আটা-ময়দা-চিনির দামও বাড়তি : ঈদের আগে বাজারে খোলা আটা কেজি বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। এখন তা বেড়ে ৪২ টাকা হয়েছে।

এছাড়া ঈদের আগে বাজারে খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা কেজি। এখন তা কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া খোলা চিনি গতকাল শুক্রবার ২ টাকা বেশি দামে ৮২ টাকায় বিক্রি হয়েছে বাজারগুলোতে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন- কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খোলা কাগজকে বলেন, স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি। এর অর্থ হলো, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছেন। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়ে নজর দেওয়া এবং যেসব ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে ভোক্তাদের শোষণের চেষ্টা করছেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ক্রমাগত কমে যাওয়া রোধ করা উচিত। এতে করে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাজারের ওপর সঠিক নজরদারি দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থাতেও ত্রুটি রয়েছে। এই ত্রুটি দূর করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এটি সব সময় সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

 
Electronic Paper