কবি
মিজান আকন্দ
🕐 ২:৪২ অপরাহ্ণ, মে ১৩, ২০২২
একটি ছেলে কবি হতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ তার কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। ছেলেবেলা থেকেই ছেলেটা কবিতা ভালোবাসে। স্কুলে নতুন বই পেলেই সবগুলো কবিতা মুখস্থ করে ফেলে। পড়ার টেবিলে বসে খাতার পাতায় মাঝে-মধ্যে দু’চার লাইন কবিতা লিখেও ফেলে। একসময় স্কুলের দেয়ালিকায় তার কবিতা ছাপা হয়। বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত সবাই লেখার প্রশংসা করে তাকে কবি ডাকতে শুরু করে। কলেজে পড়ার সময় কলেজের সাহিত্যপত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। এসময় জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় লেখার ইচ্ছে জাগে। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু কোনো পত্রিকায় তার লেখা ছাপানো হয় না।
কেন তার কবিতা ছাপা হয় না ভেবে পায় না। মনে মনে খুব কষ্ট পেলেও লেখা চালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছন্দা নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কবিতা লেখার ছন্দ আরও বেগবান হয়। ছন্দা তার কবিতায় মুগ্ধ হলেও ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি স্বপ্ন দেখে। ছন্দার কাছে কবিতার চেয়ে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তার বেশি প্রাধান্য। এরইমধ্যে সাহিত্য জগতের কতিপয় লোকের সঙ্গে ছেলেটার পরিচয় হয়। পত্রিকায় লেখালেখি করা এক কবির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। পত্রিকায় লেখা প্রকাশের জন্য পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক গড়তে হয় ছেলেটি তা জানতে পারে। চা-নাস্তার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে এক সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। নিজের লেখা কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখে তার ভালো লাগে।
কিন্তু টাকার বিনিময়ে কবিতা ছাপিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারে না। পরবর্তী তিন মাসে আরও কিছু কবিতা প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। কিছু মানুষ তার কবিতা পড়ে প্রশংসা করে। একসময় সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কথা হলে বুঝতে পারে, সম্পাদক সাহেবের চা-নাস্তার টাকা শেষ হয়ে গেছে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সে আবার কিছু টাকা পাঠায়। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় মাঝে-মধ্যে অংশগ্রহণ করে ছেলেটি। অগ্রজ কবি লেখকদের সম্মানার্থে প্রায়ই চা-নাস্তার বিল পরিশোধ করে। এভাবে চলতে থাকে কবির পথচলা। আরও কয়েকটি পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়, সাহিত্যজগতের আরও লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। দিনে দিনে তার সাহিত্য জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে খরচের হিসাব বাড়ে। সাহিত্যপথের যাতায়াত খরচের খাতাটি মাঝে মাঝে তার বুকে খচখচ করে খোঁচা দেয়। কবি-সাহিত্যিককে যতটা মহৎ প্রাণ ভেবেছিল, বাস্তবে তেমন কাউকে খুঁজে পায় না। সাহিত্যজগৎ যতটা সুন্দর সে ভেবেছিল এখন আর তেমন সুন্দর মনে হয় না!
কবি যখন কবিতার ছন্দে বিভোর, প্রেয়সী ছন্দা তখন ভবিষ্যৎ উন্নতির চিন্তার মশগুল। বিত্তশালী এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কবির সকল কবিতা পায়ে দলে ছন্দা ঐশ্বর্যের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। ছন্দাকে হারিয়ে কবি জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে। তবুও বেদনার কালো অক্ষরে খাতার পাতায় লিখে যায় সব হারানোর গান। কবি এখন আর কোনো পত্রিকায় কবিতা পাঠায় না। কোনো সাহিত্য আড্ডায় অংশগ্রহণ করে না। চা নাস্তার হিসাবের খাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কবিতা এখন নীরবে কেঁদে মরে! কবি হওয়ার স্বপ্ন অকালে মরে যায়।
সবাই জানে, কবি আর কবিতা লেখে না। প্রাক্তন কবি বলে ডাক কেউ কেউ। কিন্তু যার রক্তে মিশে আছে কবিতা, সে কী করে ছাড়বে তা। গোপন থাকে তার সকল বেদনা! আঁধারে চলে তার কলম! কবিতাকে নিজের করে রেখে দেয়।
জীবিকার তাগিদে গার্মেন্টসে চাকরি নেয় ছেলেটা। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কখনোবা নাইট ডিউটি করতে হয়। কবিতার চেয়ে জীবিকা তাকে বেশি করে দখল করে নেয়। তবুও গোপনে রক্তের ভেতর চলে কবিতার স্রোত। এভাবে চলতে থাকে কবির জীবন। সাত বছর পর পথে এক কবির সঙ্গে তার দেখা হয়! জোর করে তাকে এক সাহিত্য আড্ডায় নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে এক বিখ্যাত কবির দেখা পায়। যার কবিতা সে অনেক পড়েছে, সামনে থেকে তাকে দেখে বিস্মিত হয়! এতো বিখ্যাত এক কবির খুব সাধারণ বেশভূষা, চালচলনও অতি সাধারণ! অর্থ বিত্ত তেমন কিছু নেই, কবিতাই তার মূল্যবান সম্পদ। বিখ্যাত কবির বাসায় কেউ গেলে, তাকে ভালো বসার জায়গাও দিতে পারেন না। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, তিনি শুধু কবিতা ভালোবেসেছেন। কবিতাই তাকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে। অর্থ বিত্ত যা পারে না।
একদিন ছেলেটা বিখ্যাত কবির বাসায় যায়। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারে, তিনি শুধু বিখ্যাত কবিই নন, একজন মহৎপ্রাণ ভালো মানুষও। ছেলেটার দুটো কবিতা পড়ে বিখ্যাত কবি মুগ্ধ হন। লেখার বিষয়ে পরামর্শ ও উপদেশ দেন। ছেলেটা আবার কবিতায় প্রাণ ফিরে পায়। দিনে দিনে আরও কয়েকজন প্রকৃত কবি, লেখক ও সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সাহিত্যের প্রকৃত পথে চলতে শুরু করে।