ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জেলহত্যা দিবসের স্মৃতিকথা

তোফায়েল আহমেদ
🕐 ৯:৫৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০২, ২০১৮

প্রতিবছর যখন জাতীয় জীবনে ৩ নভেম্বর ফিরে আসে তখন জাতীয় চার নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবের আত্মত্যাগের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে পড়ে। ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা বারবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে নিজেদের জীবন তুচ্ছজ্ঞান করে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতা সংগ্রামে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে বাংলার মানুষকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করে এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। ’৪৮ থেকে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা এবং সবশেষে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পৃথিবীতে বহু নেতা এসেছেন এবং আসবেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা পৃথিবীতে আর জন্মগ্রহণ করবেন বলে আমি কখনো মনে করি না।
যে নেতা লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করতেন এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে জেল-জুলুম-অত্যাচার ফাঁসির মঞ্চকে তুচ্ছ মনে করতেন। একবার চিন্তাভাবনা করে যে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে যা বলতেন ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেন না। সেই মহান নেতার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পরমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন সেলে ৯ মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমাদের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করেছি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় চার নেতা।
যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি। ভয়ঙ্কর-বিভীষিকাময় দুঃসহ জীবন তখন আমাদের! ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে-ফাঁসির আসামিকে যেখানে রাখা হয়- সেখানেই আমাকে রাখা হয়েছিল। সহকারাবন্দি ছিলেন ‘দি পিপল’ পত্রিকার এডিটর আবিদুর রহমান। যিনি ইতোমধ্যে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।
আমরা দুজন দুটি কক্ষে ফাঁসির আসামির মতো জীবন কাটিয়েছি। হঠাৎ খবর এলো, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। কারারক্ষীরা সতর্ক। ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন নির্মলেন্দু রায়। চমৎকার মানুষ ছিলেন তিনি। কারাগারে আমরা যারা বন্দি ছিলাম তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার কারাগারে বন্দি ছিলেন, নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নির্মলেন্দু রায়কে কাছে টেনে সব সময় আদর করতেন।
সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মিস্টার ফারুক- যিনি এখন প্রয়াত- আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাতে কেন? তিনি বললেন, ‘ঢাকা কারাগারে আপনাদের প্রিয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চতুর্দিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’
আমি বললাম, না, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাকে যদি হত্যাও করা হয়, আমি এখান থেকে এভাবে যাব না। পরবর্তীকালে শুনেছি সেনাবাহিনীর একজন মেজর সেই জেলখানার সামনে এসে কারাগারে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু রায় বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেব না।’ কারাগারের চতুর্পাশে সেদিন যারা আমাকে রক্ষার জন্য ডিউটি করছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠী ওদুদ- আমরা একসঙ্গে এমএসসি পাস করেছি এবং দেশ স্বাধীনের পর ৭৩-এ যিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন- নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারাগারকে রক্ষা করার জন্য। আমি নির্মলেন্দু রায় এবং ওদুদের কাছে ঋণী।
ময়মনসিংহে কারারুদ্ধকালে জেলখানার জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুর দুঃসংবাদটি শুনে মন ভারাক্রান্ত হয় ও অতীতের অনেক কথাই মানসপটে ভেসে ওঠে।  জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতীয় চার নেতার কত অবদান। স্মৃতির পাতায় তার কত কিছুই আজ ভেসে ওঠে।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এমনকি নিষ্পাপ রাসেলকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। যাতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করতে না পারে, সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই খুনিরা শিশু রাসেলকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, জাতীয় চার নেতা হত্যারও মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের কেউ যেন নেতৃত্ব দিতে না পারে। খুনিরা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য হয়ে ধ্বংস হবে।
কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের প্রিয় বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। ’৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পতাকা তুলে দিয়ে আমরা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই পতাকা হাতে নিয়ে তিনি নিষ্ঠা-সততা-দক্ষতার সঙ্গে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-তে আওয়ামী লীগকে গণরায়ে অভিষিক্ত করে সরকার গঠন করেন এবং অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন।
আবার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে তিনি নিয়ে গেছেন। আজ আন্তর্জাতিক বিশ^ মনে করে বিস্ময়কর উত্থান এ বাংলাদেশের! যারা এক দিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বাংলাদেশের সবল-সমর্থ আর্থসামাজিক বিকাশে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি।
শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়িত হলে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে প্রিয় মাতৃভূমি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হবে এবং ২০৪১-এ হবে ‘উন্নত বাংলাদেশ’। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছিলেন-সেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে ধাবমান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও দেশের কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটছে। যদিও মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের ওপর বাড়তি চাপ, তথাপি আমাদের হৃদয়বান প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত-নিরাশ্রয় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের এ মহতী ভূমিকার প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে মর্যাদাপূর্ণ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করেছে।
জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। মহান নেতাদের সেই চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই নেতাদের আত্মা চিরশান্তি লাভ করবে এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত।  

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী।
[email protected]

 
Electronic Paper