ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাজধানী থেকে তৃণমূল

জোটের প্রভাব কতটা

রহমান মুফিজ
🕐 ১০:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৮

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে জোটভিত্তিক নানা সমীকরণ চলছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি নতুন জোট গঠিত হয়েছে। ভাঙন লেগেছে কয়েকটি জোটে। আবার কিছু জোট এগোচ্ছে সম্প্রসারণের নীতিতে। জাতীয় রাজনীতিতে জোটভিত্তিক এ ভাঙা-গড়া বা সম্প্রসারণের খেলা তৃণমূলে কতটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম, সে প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে দুদল-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে কেন্দ্র করে মূলত জোটভিত্তিক রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে।

সর্বশেষ গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য মিলে গঠন করেছে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। বর্তমানে নতুন এ রাজনৈতিক জোটটিই দেশের রাজনীতিতে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। এ জোটে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারার থাকার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ছিটকে পড়েছেন বৃহত্তর এ জোট থেকে। ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, বি. চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মিলে প্রথম থেকেই এ জোট গঠনে উদ্যোগী হয়। এ জোট গঠনের মধ্য দিয়ে বি. চৌধুরী যুক্তফ্রন্ট মূলত অকার্যকর হয়ে পড়ল। কারণ যুক্তফ্রন্টের তিন দলের দুই দল-জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক। এ জোট সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা চালাচ্ছে।
তৃণমূলে এসব জোট প্রভাব না ফেললেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয়ভিত্তিক রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এসব জোট। বিশেষ করে সরকারপন্থী ও সরকারবিরোধী জোটের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভারসাম্য ও সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। এতে নানা স্তরের পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। তা ছাড়া রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এক ধরনের সক্রিয়তা নিশ্চিত করে এসব জোট। ক্ষমতাসীনদের চাপে রাখার ক্ষেত্রে ছোট-বড় জোটগুলোর বক্তব্য বিবৃতি বা অবস্থান কখনো কখনো রাজনৈতিক সমীকরণের নিয়ামক হয়েও দাঁড়ায়। যেমনটি ভাবা হচ্ছে নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রভাব অনুমান করতে পেরে সরকারি দলের লোকজন তির্যক মন্তব্যে জর্জরিত করছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ জোট সম্পর্কে বলেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, বরং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্যই ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে নিয়ে ঐক্য করেছেন। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘কামাল হোসেনের আসলে শেখ হাসিনাকে হটানোর জন্য তারেক জিয়ার নেতৃত্ব মেনে নিতেও কোনো আপত্তি আছে বলে মনে করি না। কারণ এ ধরনের ঐক্যটা আসলে কে চালাবে? মূল দল হচ্ছে বিএনপি। আর বিএনপি চালায় কে? তারেক রহমানের অঙ্গলি হেলনেই চলবে এটা।’
ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠে, যেসব জোট কম বেশি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে সিপিবির নেতৃত্বে আট বামপন্থী দলের ঐক্যবদ্ধ জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বাইরে বামবিকল্প গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অন্য যে জোটগুলো গঠিত হয়েছে তার অধিকাংশ দলই নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত নয়। তবে এসব জোটের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ভেড়ার চেষ্টায় রয়েছে। আওয়ামী লীগও ভোটের আগে তাদের মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারণের চেষ্টায় রয়েছে। তাদের সঙ্গে সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটকে ভেড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। যদিও বামপন্থীরা সাফ জানিয়েছে দুদলের মেরুকরণেল কোনো জোটে তারা যাবে না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষির প্রস্তুতি হিসেবে জাতীয় পার্টি গত বছর গড়ে তুলেছে সম্মিলিত জাতীয় জোট নামের নতুন জোট। এ জোটের ৫৮টি দলের মধ্যে দুটি দল ছাড়া বাকি ৫৬টি দলেরই নিবন্ধন নেই। এসব দল কেবলই নামসর্বস্ব। তার আগে বিএনপি থেকে বিতাড়িত নেতা নাজমুল হুদা ৩৪ দল নিয়ে গঠন করে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএ) নামের আরেকটি জোট। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান এবং তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে এ সময়ে গড়ে উঠে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। এ ছাড়া সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামের সরকারপন্থী আরেকটি নামসর্বস্ব জোট।
প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব রাজনৈতিক জোট আদৌ সাধারণ ভোটারদের কাছে কোনো বার্তা দিতে পারছে কিনা বা তৃণমূল পর্যায়ে কোনো ধরনের প্রভাব রাখতে পারছে কিনা। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীকেন্দ্রিক এসব জোট কেবলই খবরের কাগজেই দৃশ্যমান। তৃণমূলে সাধারণ ভোটারদের কাছে কোনো প্রভাবই ফেলছে না। এমনকি সাধারণ ভোটারদের অধিকাংশই বড় দুয়েকটি জোট ছাড়া অন্য কোনো জোটের খবরই জানেন না। অথচ রাজনীতির মাঠে ১০টিরও বেশি জোট রয়েছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট মিলে যখন নতুন জোট ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছিলেন, এ জোটের প্রত্যেক নেতারই গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে তাদের যোগযোগ কম। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেলে যে শক্তি-সামর্থ্যরে প্রয়োজন তা তাদের নেই। কিন্তু তারা জনগণের সমর্থন পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।’
দেশের কয়েকটি জায়গার ভোটারের সঙ্গে কথা হয়েছে খোলা কাগজের। তারা জানিয়েছেন, তাদের কাছে প্রধান দুই দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের প্রতীক ‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ ছাড়া আর কোনো দল বা প্রতীক তেমন একটা বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি। তবে এ দুই দলের বাইরে কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে। এ তিন দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ইসিতে নিবন্ধন হারানোর পর অনেকটা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছে। এরপরও দলটির প্রভাব রয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রংপুর, নীলফামারীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় জাতীয় পার্টির প্রভাব রয়েছে। বরিশালের কয়েকটি জেলায় রয়েছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন ভোটের হিসেবে তৃতীয় স্থানে ছিল। তবে দলটি সরকার বা সরকারবিরোধী কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত নয়।
ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী যে জোটই রাজনীতিতে গড়ে উঠুক না কেন দেশে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী জোট হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট এবং সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তৃণমূলের সর্বত্র এ জোটের সমর্থক ও ভোটারই সবচেয়ে বেশি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ভোটার ও দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম খোলা কাগজ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমরা তো মার্কা চিনি নৌকা আর ধানের শীষ। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে কে কোনো জোট করল তার হিসাব রেখে আমার কি লাভ।’ তিনি বলেন, ‘এ দুই মার্কার প্রার্থী ছাড়া আর কোনো প্রার্থী তো দেখি না।’
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ভোটার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আব্দুল আলিম বলেন, ‘জোট তো আছে দুটি। একটা মহাজোট আরেকটা ২০-দলীয় জোট। দুই জোটের দুই মার্কা। মানুষ আর কোনো জোটের খবর জানে না। তবে এখানে জামায়াতের লোকজন আছে। তারা তো এখন আর নির্বাচন করতে পারবে না। তারা সবাই ধানের শীষে ভোট দেবে।’  
সাতক্ষীরার কলারোয়ার বাসিন্দা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অমিতাভ চন্দ বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ঢাকায় কত জোট হয়। কত বড় বড় নেতা এক টেবিলে বসেন। সেসব খবর আমরা পাই। কিন্তু দুই জোটের বাইরে নতুন কোনো জোট তো এখনো কোনো প্রার্থী দেয় না কখনো। হয় নৌকার প্রার্থী থাকে, নয় ধানের শীষের প্রার্থী থাকে। লোকে এ দুই মার্কার প্রার্থীতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জোটের হিসাব-নিকাশ তো আমরা বুঝব না। আমরা খালি মার্কা দেখে ভোট দেব।’

 
Electronic Paper