ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুদিকেই খেলছেন এরশাদ

রহমান মুফিজ
🕐 ১১:০৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮

নির্বাচন এলেই ‘আনপ্রেডিক্টেবল ম্যান’ জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের খেলা যেন বিচিত্র মাত্রা পায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই রহস্যজনক হয়ে উঠছে তার চরিত্র। এবার তিনি দুদিকেই খেলছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটেও থাকতে চান, আবার সরকারবিরোধী জোটেও ভেড়ার পথ পরিষ্কার করে রাখতে চাইছেন।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে ব্যক্তিগত দূত পাঠিয়ে খবরাখবর নিয়েছেন চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের। আশ্বাসও দিয়েছেন অবস্থা ‘অনুকূলে’ থাকলে তিনি যুক্ত হবেন তাদের সঙ্গে। বিএনপির হাইকমান্ডের একটি দায়িত্বশীল সূত্র এ খবর নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরশাদ মূলত অধিকতর সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকাটা যেমন তার জন্য একটা সুযোগ তেমনি আওয়ামী লীগের বিপরীতে কোনো বড় শক্তি যদি রাজনীতিতে দাঁড়িয়ে যায় এবং তাদের কাছে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়, সেটাকেও বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে নেবেন এরশাদ। সুযোগের পাল্লা যেদিকে ভারী হবে এরশাদ সেদিকেই যাবেন। এ জন্য সব ধরনের ক্ষেত্রই তার অনুকূলে প্রস্তুত রাখতে চান তিনি।
বিএনপির হাইকমান্ডের সূত্রটি খোলা কাগজকে জানিয়েছে, এরশাদের একজন বিশ্বস্ত দূত গত ১৩ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এরশাদের হয়ে তিনি বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দেন ফখরুলের কাছে। ওই দূত ফখরুলকে জানান, বিএনপি যদি শক্তপোক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, সে ক্ষেত্রে এরশাদের সমর্থন থাকবে। অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এরশাদ মহাজোট থেকে বের হয়ে রাজপথে নামবে।
সূত্রটি জানায়, এরশাদ মূলত এই বার্তা মির্জা ফখরুলকে দিয়েছেন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে জাতীয় পার্টি (জাপা) মহাজোটের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তখন তারা সরকারবিরোধী জোট হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, যে কোনো মূল্যে ক্ষমতার সংস্পর্শে থাকতে চায় দলটি। এটিই দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নীতিগত অবস্থান। যে জোট বা দল ক্ষমতায় থাকবে এরশাদ তাদের সঙ্গেই সমঝোতা করে টিকে থাকতে চায় রাজনীতিতে। ৮৮ বছর বয়সে এসে কোনো পরাজয় বা অনভিপ্রেত অসম্মান টেনে আনতে চান না তিনি। তাই সম্প্রতি দলীয় নেতাকর্মীদের শেষ ইচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন আমার শেষ নির্বাচন। আমার শেষ ইচ্ছা, জাতীয় পার্টিকে আরেকবার ক্ষমতায় দেখা।’ এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি পরোক্ষভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, এখনো ‘নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি’ হওয়ার ইচ্ছা তার ফুরিয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে বারবার কথার বরখেলাফ করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এরপরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছেন-না পারতে। সপ্তাহ খানেক আগে তিনি নিজেই বলেছেন, জাতীয় পার্টি আর গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে না, আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যাবে। দুর্নীতির অভিযোগে তার নামে দায়ের করা মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহার হয়নি বলে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিলাম। কিন্তু সুবিচার পাইনি। তারা আমাদের বন্ধু নয়।’ বলেছেন, ‘আমি এখনো মুক্ত রাজনীতিবিদ হতে পারিনি। সব সময় শৃঙ্খলবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। এখন আশা করছি, আগামী নির্বাচনে শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে মুক্ত মানুষ হব।’
সূত্রটি জানায়, এরশাদ মূলত ক্ষমতা ছাড়া কিছুই চিন্তা করতে পারেন না। এ বয়সেও স্বপ্ন দেখেন তার দল জাতীয় পার্টি আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেছেন। তিনি আবার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া তার মুক্তি নেই। মুক্ত মানুষের মতো শৃঙ্খলছাড়া জীবন চান তিনি। তার উপলব্ধি-তিনি এখনো শৃঙ্খলমুক্ত নন। এখনো তার নামে থাকা দুর্নীতি মামলাগুলো প্রত্যাহার হয়নি। মঞ্জুর হত্যামামলা এখনো দুঃস্বপ্নের মতো তাকে তাড়া করে চলে। ফলে আওয়ামী লীগের ওপর কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে তার।
জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সঙ্গে আছেন টানা ১০ বছর। ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার দল এখন সংসদে প্রধান বিরোধী দল এবং একইসঙ্গে সরকারের অংশীদারও। লোকে তাকে এবং তার দলকে নিয়ে হাসাহাসি করে বলে এক ধরনের গ্লানিবোধও আছে তার। ফলে মওকা বুঝে আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছাড়তে চান তিনি। কিন্তু তার আগে যুতসই জায়গা নিশ্চিত না হলে তিনি মহাজোট থেকে বেরুতে পারছেন না। যুতসই সে জায়গার নিশ্চয়তা এখনই দিতে পারছে না বিএনপিও।
সূত্র জানাচ্ছে, বিএনপির এখন চরম দুঃসময় চলছে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে দণ্ড ভোগ করছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে পলাতক রয়েছেন। আগামী মাসেই তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যামামলার রায় হতে পারে। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে দরকষাকষির একটা সুযোগ দেখছেন তিনি। তাই ফখরুলের কাছে দূত পাঠিয়েছেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও একটা দরকষাকষির বাস্তবতা তৈরি করছেন। গতকালই এরশাদ জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কাছে জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ১০০ আসন চেয়ে তার তালিকা পাঠিয়েছেন। এর মধ্য থেকে অন্তত ৭০ আসন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে দেবে বলে তিনি আশাবাদী। একই দিন তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার আশাবাদও জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরশাদ দুদিকেই খেলছেন। কারণ, তৃতীয় বৃহৎ শক্তি হিসেবে দুই জোটেই তার কদর রয়েছে। দুই জোট চাইবে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে হলেও এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে রাখতে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদ কিংবা অধিকসংখ্যক আসন, অথবা দুই শর্তেই যদি এরশাদকে জোটের শরিক করা যায় তাতেও লাভ দুই জোটের। ফলে রাজনীতিতে যে যতই বলুক এরশাদ ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ও ‘সুযোগসন্ধানী’, প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার রাজনীতিতে এরশাদই যথার্থ উপমা।

 
Electronic Paper