ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আট বামের নয়া জোট

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০১৮

সিপিবি-বাসদসহ ৮টি বামপন্থী দল নিয়ে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ নামের নতুন রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গতকাল বুধবার পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এ জোটের নাম ঘোষণা করা হয়।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই রাজনৈতিক জোটের বিপরীতে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ জোট গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এ জোটের নেতারা। তারা সামনের সময়ে মেহনতি মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন। গতকালই তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নতুন এ জোট। আগামী ২৪ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল, ৪ আগস্ট মতবিনিময় সভা এবং ১০ ও ১১ আগস্ট দেশের ছয় বিভাগীয় শহরে জনসভা ও মিছিল করবে তারা।
নির্বাচনী বছরে বামপন্থীদের এ জোট রাজনৈতিক মহলে নতুন আগ্রহ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বলয়ের বিপরীতে দীর্ঘদিন ধরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সিপিবি-বাসদ জোট ও বাম মোর্চা। বেশকিছু দিন ধরে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা মূলত বামপন্থী শক্তির ঐক্য প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। এবার অখণ্ড জোটে সমবেত হলেন তারা।
এ জোটের অন্তভুক্ত দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), খালেকুজ্জামান নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন ও বাসদ (মার্ক্সবাদী)। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হককে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক করা হয়েছে।
জোটের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হয়েছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বাসদ নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আকবর খান, বাসদ (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী ও ফখরুদ্দিন কবির আতিক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়নকারী জোনায়েদ সাকি, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ফিরোজ আহমেদ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু ও কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু ও কেন্দ্রীয় নেতা মমিন উর রহমান বিশাল, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক ও কেন্দ্রীয় নেতা রণজিত কুমার।
সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল হক বলেন, জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে থেকে তিন মাস পর পর একজন সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, নির্বাচনকে যে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে এর বিরুদ্ধে আমরা একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। নির্বাচন কমিশনসহ যেসব জায়গায় প্রয়োজন সেখানে আমরা লাগাতার অবরোধসহ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলব। এসব কর্মসূচি শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা দেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
এ জোট ভোট সর্বস্ব জোট নয় জানিয়ে সেলিম বলেন ইলেকশনটা আমাদের সামগ্রিক আন্দোলনের একটা অংশ। আন্দোলনের স্বার্থে ভোটে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি, আবার বয়কটও করতে পারি। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার চাই। নির্বাচনে টাকার খেলা, পেশিশক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধ করতে আমরা সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন আগামী নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচনকালে যাতে প্রকৃত নিরপেক্ষ সরকার এবং নির্বাচন কমিশন উভয়ের ক্ষেত্রে যাতে নিরপেক্ষ কর্তৃত্ব এ দেশের ওপরে থাকে সে জন্য সংবিধান সংশোধন করে হলেও সেই ব্যবস্থা অবিলম্বে চালু করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাইফুল হক বলেন, সংবিধান স্বীকৃত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ রুদ্ধ করে দমন-নিপীড়নের পথে জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা অব্যাহত রেখেছে সরকার। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অত্যাচার, নির্যাতন, হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ডে শরীরিক-মানসিক নির্যাতন, অপহরণ, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ নিয়মে পরিণত করেছে; গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিরোধী দল ও মতকে গায়ের জোরে দমন করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও ভীতি প্রদর্শনের অশুভ তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধনেও বাধা প্রদান ও আক্রমণ করা হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগকেও সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি আর দুঃশাসনে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার, শাসক-শোষক শ্রেণির মহাজোট-জোট কোনো অংশের কাছেই মানুষ যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি তাদের কাছে নিরাপদ নয় দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় সম্পদ।  সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে নতজানু লুটেরা পুঁজিপতি ধনীক-শ্রেণির দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বারা বা তাদের মধ্যে ক্ষমতার গতানুগতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে এসব সংকট ও দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। এ অবস্থায় লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণির নিষ্ঠুর শোষণমূলক ব্যবস্থা, বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেন্দ্রিক লুটেরা ধনীক-শ্রেণির দ্বিদলীয় অপরাজনীতির বাইরে জনগণের নিজস্ব বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ জোরদার করা জরুরি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক।

মেহনতি মানুষের ভূমিকাও চাই
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
আন্দোলন-সংগ্রামের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বামপন্থী দলগুলোর ঐক্য আগে থেকেই কার্যকর ছিল। আমরা এখন অখণ্ড একটি জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। বামপন্থীদের আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এ জোট। সিপিবি বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের কথা বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বামপন্থীদের বৃহৎ এ জোট গঠনের মধ্য দিয়ে মূলত মেহনতি মানুষের ঐক্য সুসংহত করার পথ প্রশস্ত হলো। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ঐক্যের বিকল্প নেই।
মূলত জনগণের অন্তরের আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনিত্ব করাই জোটের লক্ষ্য। সে আকাক্সক্ষাতে ভোটের সংখ্যায় রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের। কিন্তু এ জোট কেবল ভোটের জোট নয়। আমাদের সামগ্রিক আন্দোলন সংগ্রামের একটা অংশ হলো ইলেকশন। আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারি তেমনি নির্বাচন বয়কটও করতে পারি।
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বামপন্থীদের এ জোট ও শক্তি সুসংহত করার চেষ্টা থাকবে। একই সঙ্গে এ জোট রক্ষায় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মেহনতি মানুষের ভূমিকাও প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জোটের শক্তি সম্প্রসারণ করার কর্মসূচি আমরা দিচ্ছি।


জোটে খুশি কিন্তু আশাবাদী নই
আফসান চৌধুরী
বামপন্থীরা নতুন জোট করেছে তাতে আমি বেশ পুলকিতবোধ করছি। খুশি হয়েছি তার একত্রিত হয়েছে জেনে। কিন্তু আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ-এ দেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের কোনো ঐক্যই টিকেনি। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় কোন অবস্থান থেকে বামপন্থীরা তাদের আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করবে আমি জানি না। কারণ তারা এত বছরেও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তারা রাজনীতির একটি নৈতিক শক্তি। এ শক্তিটাও থাকা দরকার। তবে ক্ষমতায় আরোহণের মতো শক্তি তারা অদূর ভবিষ্যতে অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এক সময় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত তাদের হাতে এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের রাজনীতির নিয়ন্তা শক্তি এখন সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী, সিভিলিয়ান আমলা ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শ্রেণি। বামপন্থীদের মধ্যে এদের কেউ নেই। এরা সৎ রাজনীতির উদাহরণ হতে পারে কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে এদের কোনো ভূমিকা নেই। আর রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি তৈরির কথা তারা যেমন বলছে তেমনি ড. কামাল, বদরুদ্দোজা চৌধূরী, মাহমুদুর রহমান মান্নারাও বলছেন। তৃতীয় শক্তি মানে তো দেখছি দুই প্রধান জোটের সঙ্গে যাওয়ার জন্য দর কষাকষির জায়গা তৈরি করা। তার মধ্যে বামপন্থীরা প্রকৃতই তৃতীয় শক্তি হতে পারবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস বলে, বামপন্থীরা সব সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার জানীতিতে কিছুটা ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এখন অনেক বামপন্থীর সে নৈতিক জোরও নেই। রাশেদ খান মেননের মতো বামপন্থী নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে রাজনীতিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা তো রাখতে পারছে না। অনেকটা হারিয়ে গেছে বলা যায়। যে সময় দেশের গোটা রাজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপির দখলে-যেখানে সাধারণ মানুষের জায়গা নেই, শুধু বড়লোকেরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানে বামপন্থীদের এ জোট রাজনীতিতে কী পরিবর্তন ঘটাবে তা সময়ই বলবে। তবে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনো রাজনৈতিক ধারা তৈরি করতে না পারলে তাদের ঐক্য কার্যকর হবে না।

 
Electronic Paper