স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বে ‘চাঁদাবাজ’
যুবলীগ নিয়েও সংশয়
হাসান ওয়ালী
🕐 ১০:০৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৮, ২০১৯
শুদ্ধি অভিযান-পরবর্তী কাউন্সিলে ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব উঠে আসবে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন কর্মীরা। কিন্তু সে স্বপ্নে গুড়েবালি! সদ্য অনুষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাউন্সিলে মহানগর উত্তরে সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত চাঁদাবাজিসহ বহু অভিযোগে অভিযুক্ত আনিসুর রহমান নাঈম। নাঈম দায়িত্ব পাওয়ার পরই শহরজুড়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা আশঙ্কা করছেন আসন্ন যুবলীগের কাউন্সিলেও নব্য সম্রাটদের উত্থান হতে পারে।
আগামী ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুবলীগের সপ্তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন (কংগ্রেস)। যুবলীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১২ সালের ১৪ জুলাই। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন হারুন-অর-রশিদ।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের ‘মনস্টার’দের দৌরাত্ম্যের লাগাম টানতে হার্ডলাইনে যান। শুরুতেই ধরেন নিজ দলের ছাত্র সংগঠনকে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বেপরোয়া হয়ে ওঠার চিরচেনা চিত্রের ‘স্বাভাবিক’ ঘটনায় ছেদ ঘটান তিনি। দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দেন তিনি। এরপরই যুবলীগের কিছু নেতার কর্মকা- নিয়েও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থানের চার দিন পর থেকেই শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। একে একে আটক হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, প্রভাবশালী নেতা জি কে শামীমসহ সব বাঘা বাঘা নেতা। নেতাদের অপকর্মে ইন্ধন জোগানোয় সরিয়ে দেওয়া হয় ৭১ বছর বয়সী যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে। একই অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকেও সম্মেলনের আগেই সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর অবস্থানেও ঠেকানো যায়নি চাঁদাবাজদের। স্বেচ্ছাসেবক লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার ঠিকই দখল করে নিয়েছেন বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার ‘সম্রাট’ আনিসুর রহমান নাঈম। যার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জমি দখল, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধের সঙ্গেই তার যুক্ততার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেই নাঈম শুদ্ধি অভিযানের ফাঁক গলে নেতা বনে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন নিবেদিত কর্মীরা। তারা বলছেন, নাঈমের মতো বিতর্কিত ব্যক্তি নেতা হওয়ায় শুদ্ধি অভিযান নিয়েই সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে। একই সঙ্গে আসন্ন যুবলীগের কাউন্সিল এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে যেন কোনো সুবিধাভোগী নেতা বনে না যায় সে দাবি তাদের।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগের নেতা নির্বাচনে বয়সসীমা ৫৫ বছর বেঁধে দেওয়ায় নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছে সংগঠনটিতে। এ শর্তে সম্মেলনে যুবলীগের ৮০ ভাগ নেতাই বাদ পড়তে যাচ্ছেন; নেতৃত্ব উঠছে অপেক্ষাকৃত তরুণদের হাতে। এ সুযোগে সামনে চলে আসছেন এতদিন রাজনৈতিক পরিচয় সংকটে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। এ সিদ্ধান্তে যুবলীগের সভাপতিম-লীর ২৯ সদস্যের মধ্যে বাদ পড়ছেন ২৬ জন। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় ৮০ শতাংশ নেতা বাদ পড়তে পারেন বলে জানা গেছে। সামনে চলে এসেছেন অপেক্ষাকৃত তরুণরা। যুবলীগের শীর্ষ দুই পদে আলোচনায় থাকা নেতাদের মধ্যে বয়সসীমার শর্তে টিকেছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। অপর ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ, নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, শেখ সেলিমের ছেলে এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম, যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থবিষয়ক সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হাওলাদার, বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সুব্রত পাল, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু।
তবে নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধু যুবকদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিলেই যুবলীগকে শুদ্ধ করা যাবে না। ক্যাসিনো হোতা, চাঁদাবাজমুক্ত নেতৃত্ব না এলে শুদ্ধি অভিযানের মূল ‘ভিলেন’ যুবলীগকেও শুদ্ধ করা যাবে না। সম্রাটের শিষ্যদের রুখা না গেলে শুদ্ধি অভিযানের সুফল স্থায়ী হবে না। সেক্ষেত্রে যুবলীগকে গতিতে ফেরাতে শুধু বয়সসীমা নির্ধারণই নয়, ক্লিন ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি তাদের। এ প্রসঙ্গে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ খোলা কাগজকে বলেন, ‘যুবলীগের নেতৃত্ব তরুণদের হাতে থাকবে। নির্ধারিত বয়সের মধ্যেই ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব আনা হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। যুবলীগে যারা আছেন তারা যে কেউ সংগঠন চালানোর যোগ্যতা রাখেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি প্রতিষ্ঠিত যুবলীগকে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিবেচনা করা হয়। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুবলীগের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেন ছিলেন যুবলীগ কর্মী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ দখল করে যুবলীগ। আওয়ামী লীগের ‘ভ্যানগার্ড’ হয়ে শক্তিশালী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সুনাম ছিল সংগঠনটির।