ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ফেঁসেই যাচ্ছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান

শফিক হাসান
🕐 ১০:৩০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০১৯

সহযোগী সংগঠনগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার নীতিগত সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে শুরু হয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কাউন্সিল হবে আগামী দুই মাসের মধ্যেই। এ উপলক্ষে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় ও কেন্দ্রীয় কার্যালয় গুলিস্তানে শুরু হয়েছে নেতাকর্মীদের ‘গণজোয়ার’। তারা চাইছেন শীর্ষনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে। বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তরা শাস্তি এড়ানোর পাশাপাশি পদ ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

পরিবর্তনের এমন জোয়ারে কোথাও নেই যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম। নিজের পদ ধরে রাখার জন্য কোনো ‘প্রতিযোগিতা’য় যাচ্ছেন না তিনি। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে প্রায় একমাস ‘স্বেচ্ছা নির্বাসনে’ আছেন। যদিও এই সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ লেনদেনের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজরবন্দি রেখেছে ৭১ বছর বয়সী যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে।

রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন যাবৎ যুবলীগ চেয়ারম্যানের পদের অপব্যবহারকারী ওমর ফারুক চৌধুরী শেষ পর্যন্ত ফেঁসে যাচ্ছেন। তার শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের বিপরীতে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই হাল ধরেছেন শুদ্ধি অভিযানের। নীতির প্রশ্নে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেও নারাজ তিনি। দলের নাম ভাঙিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য পরিচয় দিয়ে যারা অপকর্মে লিপ্ত- শনাক্ত করা হয়েছে এদের। যুবলীগ চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়; এ পরিচয় কোনো প্রভাববিস্তারী কাজে ব্যবহার করেছেন কিনা তাও অনুসন্ধানের আওতায় আছে।

রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনোকা-ের পর থেকে আলোচনায় রয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটকের পর নরম-গরম বক্তব্য দেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান। মিরপুরের দলীয় একটি অনুষ্ঠানে ‘আঙ্গুল চোষা তত্ত্ব’ দিয়ে পক্ষান্তরে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের হোতা যুবলীগকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। এরপর পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগের আরও কয়েকজন নেতা। পরিস্থিতি অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে ওমর ফারুক চৌধুরী ভোল পাল্টে নরম পন্থায় আসেন। নেতাকর্মীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পুলিশ গ্রেফতার করলেই তাকে বহিষ্কার করা হবে। এমন পন্থায় কর্তব্য এড়িয়ে ‘সুবিধাবাদী’ অবস্থান নেন। যুবলীগের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠা ওমর ফারুক চৌধুরী অন্যদের পাশাপাশি নিজেকেও ঠেলে দিয়েছেন বিতর্কের মুখে। নানা অন্যায়-অপকর্মের আখড়া হয়ে উঠেছিল সংগঠনটি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে নানা কাজেই ব্যবহার করতেন ফারুক। সব কাজ সম্রাট গুছিয়ে আনলে ‘ফিনিশিং’ টাচ দিতেন তিনি। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পন্থায় ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতাদের। চাপের মুখে বহিষ্কার করা হয়েছে যুবলীগের পলাতক দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানকে।

আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ এই মাধ্যমেই যোগাযোগ করতে হতো যুবলীগ চেয়ারম্যানের সঙ্গে। নেতাকর্মীরা কাজী আনিসকে জানে যুবলীগ চেয়ারম্যানের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবেই। তার আমলনামার সবচেয়ে বড় সাক্ষী দফতর।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেখানেই হাত দিচ্ছে, বেরিয়ে আসছে আরব্য রজনীর গল্পের মতো সম্পদের গুহা। ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রে দেখা মিলছে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার পর অনৈতিক উপায়ে টাকার পাহাড় বানিয়েছেন নেতাকর্মীরা; চেয়ারম্যানের নিজের সম্পদের পরিমাণ কত! এমন কৌতূহল নিবৃত্তের জন্য টানটান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে দেশবাসী।

গত ১১ অক্টোবর যুবলীগের সভাপতিম-লীর বৈঠক হলেও অংশ নেননি ওমর ফারুক চৌধুরী। তাকে ছাড়াই মিটিং করেছে যুবলীগ। সংগঠনটির কাউন্সিল আগামী ২৩ নভেম্বরে। কাউন্সিলে পদ হারাতে পারেন ফারুক, ইতোমধ্যে সেই আলামতের দেখা মিলেছে। পদ হারানোর আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ইঙ্গিত অনুযায়ী গ্রেফতারও হতে পারেন। গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা আরও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছেন। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নেতৃত্বে আসতে পারেন পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা। যারা দলের জন্য বিভিন্ন সময় নিবেদিত থাকলেও পাননি যোগ্য মূল্যায়ন।

সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, যোগ্য নেতৃত্বের হাতে পড়লে যুবলীগ ফিরে পাবে হৃত ঐতিহ্য। বঞ্চিত কর্মীরাই শুধু নন, আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা বর্তমানে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে মুখ খুলছেন। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন যুবনেতা। গণভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির পর সংশ্লিষ্টরা অবগত হয়েছেন, ফারুক প্রধানমন্ত্রীর গুড বুকে নেই। সম্রাট, খালেদসহ সংশ্লিষ্টদের অনেক অপকর্ম প্রকাশ্য হলেও যুবলীগ চেয়ারম্যানকে নিয়ে বরাবরই একধরনের ধোঁয়াশা ছিল। চরিত্রের ইতি-নেতি সম্বন্ধে ধারণা করতে না পারায় সৃষ্টি হয় এমন সংশয়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ফারুক নিজেই অবস্থান পরিষ্কার করেছেন! নেপথ্যের গডফাদারদের শনাক্ত করা না গেলেও পরিষ্কার হয়েছে ঠিকুজি।

যুবলীগ চেয়ারম্যান দলে থাকবেন কিনা, কারা আসছেন নতুন নেতৃত্বে আভাস মিলবে আগামীকাল রোববার। গতকাল শুক্রবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে রোববার গণভবনে সভা ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সংগঠনটির চেয়ারম্যানকে ডাকা হয়নি। কাকে ডাকবেন আর কাকে ডাকবেন না, সেটা প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। কত বছর পর্যন্ত যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা যাবে সে বিষয়েও আলাপ হবে বলে জানান কাদের।

যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ জানান, সম্মেলন ও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়া হবে। বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরী যাতে অংশ না নেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এমন বক্তব্য থেকেই অনুমেয় কৃতকর্মের মাশুল দিতে হবে ওমর ফারুক চৌধুরীকে। তিনি নিজেও ‘অপেক্ষা’ করছেন। যুবলীগ থেকে ‘স্বেচ্ছা অবসর’ নেওয়ার পর যোগাযোগ রাখছেন না দলের কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে। প্রায় ১০ বছর একক কর্তৃত্বে সংগঠন চালিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থের বিনিময়ে বিতর্কিতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোসহ অপরাধে নীরব ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

৬৪ বছর বয়সে, ২০১২ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ফারুক। কাউন্সিল না হওয়ায় সাত বছর ধরে একই পদে বহাল রয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের সম্মেলন হবে আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর, যুবলীগের ২৩ নভেম্বর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১৬ নভেম্বর, কৃষক লীগের ৬ নভেম্বর ও শ্রমিক লীগের ৯ নভেম্বরে। এসব সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পেতে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ‘পরিশুদ্ধ’ চেহারা এমন ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

 
Electronic Paper