ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গডফাদার কে কোথায় থাকে

শফিক হাসান
🕐 ১১:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯

আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর ক্যাসিনো কালচার। ঢাকা শহরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্যাসিনো গড়ে তুলেছিলেন যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গত বুধবার আটক করার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আটক হন যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি সফিকুল আলম ফিরোজ। শেষোক্ত দুজনকে আদালত শনিবার বিভিন্ন মেয়াদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ক্ষমতার মদমত্তে ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন যারা, তাদের এমন পরিণতিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সাধারণ মানুষ। ‘আইন সবার জন্য সমান’ এটা অনেকাংশেই কথার কথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে কিঞ্চিৎ কার্যকারিতা মিলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এ সাঁড়াশি অভিযানে সোচ্চার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ দেশের মানুষ।

মানুষের একটাই জিজ্ঞাসা, চুনোপুঁটি ধরার মাধ্যমে এ অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে কিনা! এদের যারা চালান সেই গডফাদাররা বরাবরই থেকে যান দৃশ্যের আড়ালে। গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচনের পাশাপাশি আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন দেশের সচেতন মানুষ। সুশীল সমাজও এ ইস্যুতে সোচ্চার। গডফাদাররাও সাজার মুখোমুখি হয়ে বেরিয়ে আসবে; ভদ্রলোকের মুখোশের বাইরে আসল চেহারা এমন প্রত্যাশাই সাধারণ মানুষের। এ ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। বছরের পর বছর আইন ও সংস্কৃতিবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড চলে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করেছে, গোয়েন্দা বিভাগেরই বা ভূমিকা কী ছিল। এমন প্রশ্ন উচ্চকিত হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে শনিবার খোলা কাগজ মুখোমুখি হয়েছে দুজন বিশিষ্টজনের।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে চলেছে ক্যাসিনো কালচার, এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতি রয়েছে। গাফিলতির বিষয়ে সন্দেহ করা যায়। এ অভিযানের নেপথ্যে থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তাদের পরিচয় উন্মোচিত হবে কিনা জানি না। আমি জ্যোতিষী নই। তবে অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্যই তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা উচিত।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিল কেন, এ মর্মে একটা সন্দেহ থাকতেই পারে বলে মন্তব্য করেন পুলিশের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা।

লেখক-বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘স্পোর্টিং ক্লাবগুলোর কাজ খেলাধুলা ও শরীরচর্চা। আগে জানা গেছে, সেখানে জুয়ার আড্ডা বসে। এখন যোগ হয়েছে ক্যাসিনো। সেগুলোতে এ অবৈধ ক্যাসিনো কালচার চলছে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও সরকারি দলের নেতারা জানতেনই না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। উচ্চপর্যায়ের ছত্রছায়া ছাড়া এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘র‌্যাবের অভিযানের পর সরকারি দলের নেতারা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তা সন্তোষজনক নয়। ক্যাসিনোগুলো থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা এবং দামি বিদেশি মদ উদ্ধার করেছে। কালো টাকা অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। হয় তা বিদেশে পাচার হবে অথবা তা কোনো অপরাধমূলক কাজে ব্যয় করা হবে। এ ক্যাসিনো ব্যবসা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।’

ক্যাসিনোর সঙ্গে যারা যুক্ত তারা জঙ্গিদের মতোই ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেন এ সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।

সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও বলেন, ‘এখন দেখার বিষয়, যে অভিযুক্তরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে আটকা পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শুধু যে ঢাকাতেই ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে তা ভাবার কারণ নেই। চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরেও যে এই সামাজিক রোগ ছড়িয়ে পড়েনি তা বলা যায় না। সুতরাং এ অভিযান শুরু হয়েছে জনগণ তাতে অভিনন্দন জানিয়েছে। এখন জনগণের প্রত্যাশা, এ সমাজবিরোধী কাজের নির্মূল।’

যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী এ ইস্যুতে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন। খালেদের গ্রেফতারের পর থেকে তিনি যে গরম-নরম বক্তব্য দিয়েছেন তারপর সুর পাল্টেছেন এতে করে আরও বেশি মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন তিনি। অভিযুক্ত আরেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের সমালোচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে। সম্প্রতি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে।

এ ইস্যুতে যুবলীগের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কোনো কোনো যুবলীগ নেতা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। নানা অপরাধে অভিযুক্ত ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এ বার্তা টের পেয়েছিলেন আগেই। যে কারণে তিনি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। খালেদের গ্রেফতারের পর আতঙ্কে থাকা সম্রাট সেদিন রাতেই যুবলীগের কয়েক হাজার কর্মী নিয়ে যুবলীগ কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এ আগমনেও সমালোচিত হয়েছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান।

কৌতূহলী মানুষ প্রশ্ন তুলেছিল, ওমর ফারুক চৌধুরী অপরাধ দমন করবেন নাকি অপরাধীকে লালন করেন! বক্তব্যে যদিও তিনি দায়িত্ব পালনে কিঞ্চিৎ ভুল-ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন সেটাকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ব্যাপার বলে মন্তব্য করছেন অন্যরা।

পরিস্থিতি বুঝে যুবলীগ চেয়ারম্যান যখন যা খুশি বললেও তার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে গতকাল রাজধানীতে প্রতিবাদ জানিয়েছে একটি সংগঠন।

যুবলীগের প্রতি প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করার পরপরই যে অভিযান চালানো হচ্ছে, এতে আরও সমালোচিত হচ্ছে পুরো ব্যবস্থাপনা। সবকিছুতেই কেন প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি দিতে হবে, তার হস্তক্ষেপ ছাড়া কোথাও কোনো সংস্কারমূলক কাজ হয় না। ‘উল্টে দে মা, লুটেপুটে খাই’ ধরনের যে অপসংস্কৃতি চলছে তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী একা কত লড়াই করতে পারবেন! নানাভাবে স্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারা চালিয়ে যাওয়া মানুষের পর সত্যিকার অর্থে কতজন মানুষ পাশে আছেন প্রধানমন্ত্রীর, দেশ এবং দেশের মানুষকে তারা ভালোবাসেন কিনা এমন প্রশ্ন আজ চারদিকে ধ্বনিত হচ্ছে।

গত ক’দিন ধরে ক্যাসিনো ইস্যুতে সরগরম ফেসবুক। অনেকের একটিই প্রশ্ন- শুধু চুনোপুটি ধরে কী লাভ, মূল গডফাদাররা চিহ্নিত হবে কবে! এখানটায় এসে একটু নড়েচড়ে বসতে হয়। ক্রসফায়ারের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথাই চালু হয়েছে। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে অতীতে অনেক সময় মামলার সাক্ষী তথা আলামত নষ্ট করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাশালী কাউকে আড়াল করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন এখনো অনেকের মুখে মুখে।

এ ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের ক্যাসিনো কালচারের বিরুদ্ধে নানা অভিযানের সাযুজ্যও খুঁজছেন কেউ কেউ। চুনোপুঁটি ও মাঝারি মানের অপরাধীদের ধরা হলেও নেপথ্যের হোতারা কোথায়! যুবলীগ নেতারা শুধু নিজেদের উদ্যোগে হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাবেন দিনের পর দিন তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। যাদের ছত্রছায়ায় চুনোপুঁটিরা দানব হয়ে ওঠে, আইনবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যায়- একসময় ভাগবাটোয়ারার গরমিলেও তারা প্রকাশ্যে চলে আসে কিন্তু নেপথ্য কুশীলব বরাবরই থেকে যান নিভৃতে।

কয়েকজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী গ্রেফতার হওয়ার পর মোটাদাগে যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে- সংশ্লিষ্ট থানা ও প্রশাসন কী করেছে এতদিন? কেন তারা এর আগে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গোয়েন্দা সংস্থার নীরবতাও এক ধরনের প্রহসন। একশ্রেণির হলুদ সাংবাদিকও জড়িত এর সঙ্গে। কোটি টাকার বাণিজ্যের ভাগ পৌঁছে যেত বিভিন্ন জায়গায়। টাকা দিয়েই বন্ধ করা হতো অনেকের মুখ।

বাংলাদেশে অপরাধীরা বরাবরই থেকে যায় আড়ালে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সরকারের প্রভাবশালী অংশ কেউই এদের সামনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে থাকত না। বরং ভূমিকা থাকত সহযোগীর। রক্ষক ভক্ষক হলে সাধারণের দুর্ভোগ বাড়ে। সেই দুর্ভোগেই জাঁতাকলে নানাভাবে পিষ্ট হচ্ছে দেশ। মাঝে-মধ্যে অল্পসংখ্যক অপরাধী আইনের আওতায় এলে সাধারণ মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়। যদিও প্রত্যাশার প্রতিফলন খুব বেশি দূরে যায় না। অপরাধীরা একপর্যায়ে ফিরে আসে নতুন শক্তি নিয়ে, ভিন্ন উদ্যমে। বর্তমানে সরকার ও প্রশাসনের ক্যাসিনোবিরোধী অবস্থানে দেশের মানুষ যারপরনাই খুশি। তারা প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন, গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচনের আগ পর্যন্ত অভিযান যেন না থামে। ছবির পেছনের ছবি, আলোর আড়ালে অন্ধকার মুখাবয়বটা দেখার আগ্রহ রয়েছে শান্তিপ্রিয় মানুষের।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বর্তমানে ঢাকায় চার নেতার ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে রমরমা ক্যাসিনো বাণিজ্য। মূলত মতিঝিল এলাকাকে কেন্দ্র করেই এর পসার ঘটেছে। মতিঝিলের স্পোর্টস ক্লাবগুলোতে জুয়ার আসর বসত আগে। সেটাকে ক্যাসিনোতে উন্নীত করার মূল উদ্যোক্তা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। তার সহযোগী হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আসেন যুবলীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

এরপরে অন্যতম উদ্যোক্তা হলেন- স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ। সাঈদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পুরো মতিঝিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার। র‌্যাবের চলমান অভিযানের বিষয় টের পেয়ে বর্তমানে তিনি বিদেশে পলাতক।

রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরেও ক্যাসিনো পরিচালনা অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করা অনেকের বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারিত হচ্ছে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নাম। নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ঢাকার অপরাধ জগতের সম্রাট। এ সম্রাট বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরবন্দি থাকলেও যুবলীগ চেয়ারম্যান তাকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। এমন অভিযোগ ভাসছে ঢাকার বাতাসে।

এ মুহূর্তে ঢাকাবাসীসহ সবার একটাই দাবি- গডফাদারদের মুখোশ খোলা হোক, তাদের আনা হোক মানুষের সামনে। সিনেমায় গডফাদারের পতন হলেও বাস্তবে তেমন হয় না। বর্তমানে সিনেমাটিক একটি মুহূর্তের অপেক্ষা পুরো বাংলাদেশ!

 

 
Electronic Paper