ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এখনও আড়ালে ক্যাসিনো সম্রাট

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯

ঢাকায় অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গত বুধবার র‌্যাব গ্রেফতার করার পর যুবলীগের অন্য নেতাদের মধ্যেও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। খালেদকে গ্রেফতারের পর ওই দিন রাতে ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট দলবল নিয়ে কাকরাইলে দলীয় কার্যালয়ে আসেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তাকে বাইরে বের হতে দেখা যায়নি।

জানা গেছে, দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কঠোর মনোভাব দেখানোর পর এবং এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়ার পর দুর্নীতিবাজদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। যুবলীগ নেতা খালেদকে গ্রেফতারের পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। খালেদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত শুক্রবার গ্রেফতার করা হয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। তিনি ওই দিন গভীর রাতে কাকরাইলে দলের অফিসে প্রবেশের পর আর বের হননি।

যুবলীগের একটি সূত্র বলছে, ভবনের চতুর্থতলায় সম্রাটের জন্য আলিশান থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরো ভবনটি আগে থেকেই নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে ছিল। সম্প্রতি সেই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ঘনিষ্ঠ কর্মীদের তিনি জানিয়েছেন, বুধবারের পর থেকে তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। এমন অবস্থার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তারা আরও বলছেন, সম্রাটের হার্টে পেসমেকার বসানো রয়েছে। এজন্য তিনি মাঝেমধ্যেই বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করান। শিগগিরই বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। তার জরুরি চিকিৎসারও দরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি বিদেশ যেতেও পারছেন না।

তবে গোয়েন্দা সূত্র বলছেন, সম্রাট তাদের নজরদারিতে রয়েছে। গ্রেফতারের জন্য তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছেন। ঢাকায় ক্যাসিনো বিস্তার লাভ করে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ছত্রছায়ায়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তার অধীন ক্যাসিনোর সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। আর এসব ক্যাসিনো থেকে প্রতিরাতে তার পকেটে ঢোকে ৪০ লাখ টাকারও বেশি। ঢাকায় ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটায় নেপালি নাগরিক দীনেশ ও রাজকুমার। সম্রাটের তত্ত্বাবধানে এরা একের পর এক ক্যাসিনো খুলে বসে ঢাকা শহরে। এসব ক্যাসিনোতে কর্মরত নেপালিদের হাত ধরে কোটি কোটি টাকা নেপালেও পাচার হয়েছে।

জানা গেছে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হয়। বৈঠকের এজেন্ডায় উল্লেখ থাকা শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনের আলোচনায় অংশ নিয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক যুবলীগের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন। পরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শনিবার যুবলীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা করেছিল। তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, কীসের টাকা বৈধ করতে মিলাদ মাহফিল করা হয়েছে? চাঁদাবাজির টাকা বৈধ করতে মিলাদ মাহফিল!’ নিজের জন্য এমন মিলাদ মাহফিল তিনি চান না। শেখ হাসিনা আরও বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। এসব বন্ধ করতে হবে।

ছাত্রলীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে তুলনা করে যুবলীগের কিছু নেতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরা আরও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা (ঢাকা মহানগর যুবলীগের একটি অংশের সভাপতি) ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেছেন। আরেকজন (মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক) এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর মনোভাবের পরই গ্রেফতার হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। খালেদের গ্রেফতারের পর সম্রাটের মধ্যেও গ্রেফতার আতঙ্ক শুরু হয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সম্রাটের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর গিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগ রয়েছে। মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলেন। এটি তার নেশা। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে।

এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’-এ করে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হন যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমানুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম। এদের মধ্যে সাঈদ কমিশনারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ১০ বছর আগে ঢাকায় গাড়ির তেল চুরির ব্যবসা করতেন। এখন তিনি এলাকায় যান হেলিকপ্টারে। এমপি হতে চান আগামী দিনে। এ নিয়ে তোড়জোড়ও শুরু করে দিয়েছেন। দোয়া চেয়ে এলাকায় লাগাচ্ছেন পোস্টার। যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের অফিস কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের উল্টোপাশে (পশ্চিম)। সেখানেও গভীর রাত পর্যন্ত ভিআইপি জুয়া খেলা চলে।

প্রতিদিনই ঢাকার একাধিক বড় জুয়াড়িকে সেখানে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সম্রাটের অফিসে খেলার নিয়ম ভিন্ন। সেখান থেকে জিতে আসা যাবে না। কোনো জুয়াড়ি জিতলেও তার টাকা জোরপূর্বক রেখে দেয়া হয়। নিপীড়নমূলক এ জুয়া খেলার পদ্ধতিকে জুয়াড়িরা বলেন ‘চুঙ্গি ফিট’। অনেকে এটাকে ‘অল ইন’ও বলেন। জুয়া জগতে ‘অল ইন’ শব্দটি খুবই পরিচিত। অল ইন মানে একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া। সংসারের ঘটিবাটি বিক্রি করে একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মতোই জুয়াড়িদের ‘অল ইন’।

 
Electronic Paper