ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জয়ে ফ্যাক্টর নগর জাপা

রংপুর-৩ উপনির্বাচন

শফিক হাসান
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯

‘আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে এমন স্লোগান দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রচারণামূলক স্লোগানে বাংলাদেশ ‘বাঁচানোর’ পরিকল্পনা নিয়েছিল যে জাতীয় পার্টি (জাপা) সে দল আজ নিজেদের কাছেই বড় অচেনা! আয়নায় মুখ ও মুখোশের বদলে দেখা যাচ্ছে অপরিচ্ছন্ন জলের বুদবুদ!

জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য হয়েছে রংপুর-৩ আসন। আসনটিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামী ৫ অক্টোবর। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাপারই দুজন। দলীয় প্রার্থী এরশাদ-রওশনপুত্র সাদ এরশাদ; দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ‘অবাধ্য’ অভিযোগে জাপা থেকে বহিষ্কৃত এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার।

ইতিপূর্বে ‘রংপুরের মাটি জাপার ঘাঁটি’ স্লোগানকে জনপ্রিয় করা হলেও এবার আলামত মিলছে না। এমন ‘অদ্ভুত’ ও ‘ঘটনাবহুল’ নির্বাচন বোধকরি আগে দেখেনি কেউ! আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় রাজনীতি এ নির্বাচনে এক ধরনের নীরবতা পালন করছে। সম্প্রতি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন দেবর-ভাবি। চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হিসেবে শেষপর্যন্ত তারা বহাল থাকবেন এমনটি সাব্যস্ত হলেও কিঞ্চিৎ রদবদল ঘটেছে।

জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ, তার ছেড়ে দেওয়া পদ সংসদ উপনেতার আসন অলংকৃত করেছেন জি এম কাদের। দেবর-ভাবির বিবাদের সূত্র ধরেই জাপা মনোনীত প্রার্থীকে প্রত্যাহার করা হয় রংপুর-৩ আসনে; সেখানে জায়গা করে নেন রাজনীতিতে আনকোরা সাদ এরশাদ।

সাদকে ঘিরেই আঞ্চলিক রাজনীতিতে (নগর ও জেলা) সৃষ্টি হয়েছে চাপা ও প্রকাশ্য ক্ষোভ। কেন্দ্রীয়ভাবেও অনেকেই এ সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি। এটাকে জাপার কফিনে নিজেদের হাতে পেরেক ঠোকার শামিল বিবেচনা করছেন তারা। এ উভয় সংকট থেকে উত্তরণে নগর জাপার ঐকমত্যের বিকল্প নেই। জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সাদকে সমর্থন দিয়েছেন; ইতিপূর্বে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকও সাদকে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদ ছেলের জন্য পদ বাগাতে বড় ফাইট দিলেও সায় ছিল না জি এম কাদেরের।

প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে জাপা দুইভাগে বিভক্ত। রংপুর মহানগরীর রাজনীতিতে বলিষ্ঠ সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাও এমন সিদ্ধান্তে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। উল্টো প্রশ্ন করেছেন, কে ভোট দেবে সাদকে! অন্যদিকে রংপুরের পরিচিত মুখ আসিফ শাহরিয়ারও ভাইয়ের প্রতি বিরূপ। সাদ সত্যিই এরশাদের পুত্র কি-না এমন প্রশ্ন তুলে দাবি করেছেন ডিএনএ টেস্টের।

এ ছাড়াও তাকে বহিরাগত, শিশু, ভাড়াটিয়া অভিধায় অভিহিত করছেন প্রায়ই। আসিফের কর্মী-সমর্থকরা সাদ ঠেকাও আন্দোলন করতে গিয়ে কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। ‘নির্বিরোধী’ সাদের কুশপুত্তলিকা দাহের পাশাপাশি তাকে নিয়ে যে সব নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেখানেও কোনো হেলদোল নেই দলের কারোরই। এ যেন ‘ভাসুরের মুখে মুখে কথা বলতে নেই’! হাইকমান্ডও যথারীতি নিশ্চুপ। সমালোচনার পাল্টা জবাব না দিয়ে আশ্চর্যজনক নীরব ভূমিকা সবার। ঘরে-বাইরে কোথাও ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নেই যে সাদের, তিনি কীভাবে পার হবেন নির্বাচনী বৈতরণী! রাজনীতির চর্চায় তিনি সত্যিকার অর্থে আন্তরিক কি-না সেখানেও বিরাজ করছে একধরনের ধোঁয়াশা। বলা হয়, কুয়াশার চেয়ে অন্ধকার ভালো। সাদ কি তবে কুয়াশা ও অন্ধকার দুটিকেই একত্রে গুলিয়ে ফেলছেন!

জাপার এ নিদানকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উপনির্বাচনে বিজয়ী হতে নগর জাপার ঐক্যের বিকল্প নেই। ভেদাভেদ ভুলে দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চাইলে গৃহবিবাদ, আত্মবিধ্বংসী মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এদিকে মহানগর জাপা একেবারেই চুপ, জেলা জাপায়ও রয়েছে বিকারহীন মনোভাব। জংধরা এ লাঙ্গল তবে কোনদিকে যাবে! ভুঁইফোড় নেতা সাদ এরশাদের প্রতি বিরক্ত স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভোটাররাও। ‘ছাওয়াল’ মনোপুত না হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা নীরব সমর্থন দিচ্ছেন আসিফকে।

শেষপর্যন্ত জাপাকে কাত করে আসিফই বিজয়ী হতে পারেন। জাপায় ‘অবাঞ্ছিত’ হলেও রংপুরের অনেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। আসিফের জনসম্পৃক্ততা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির প্রতি সাধারণ ভোটাররা আস্থাশীল। ভাইকে উদ্দেশ্য যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন সেটাও ‘রাজনৈতিক প্রজ্ঞা’রই পরিচায়ক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নগর জাপাকে সাদমুখী করতে প্রয়োজন রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) মেয়র মোস্তফাকে ‘ম্যানেজ’ করা। প্রশ্ন হচ্ছে, কে ভাঙাবেন তার অভিমান! রওশন কিংবা জি এম কাদের কারোরই তোড়জোড় দেখা যায়নি এখনো। ক্ষুব্ধ কাদের নীরব থাকতেই পারেন কিন্তু রওশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ভরাডুবি নিশ্চিত করতেই কি ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ও অনাবশ্যক আত্মম্ভরিতা! রওশন এরশাদ ‘ভেতরে ভেতরে’ অন্য কোনো ছক আঁকছেন কি-না- অপরিস্ফুট এখনো।

বরাবরই জাপার জিম্মায় থাকা এ আসন থেকে ছিটকে পড়লে তা হবে বড় হার। প্রার্থীর নয়, এ হার হবে দলের! অশনিসংকেত দেখা দিলে রংপুরে জাপার রাজনীতি নড়বড়ে হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। বড় বিষয়, সাদের হারে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আপাতত ‘পরাজিত’ জি এম কাদেরেরও উচ্ছ্বসিত হওয়ার যৌক্তিক কারণ নেই। সাদ উড়ে এসে জুড়ে বসলেও এ আসন জাপারই।

নগর ও জেলার রাজনীতির সমন্বয়ে, কেন্দ্রের উদ্যোগে নতুন মেরুকরণের সুযোগ রয়েছে এখনো। সমীকরণ পাল্টাতে প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ। জাপার অনুরোধে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীও সমালোচিত, তুলনামূলক দুর্বল। শক্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতিতেও এ আসনে হারলে তা হবে জাপার জন্য লজ্জার।

অন্তর্দ্বন্দ্বে জাপার ৩৩ বছরের ইতিহাস পাল্টে গেলে লাভবান হতে পারে আওয়ামী লীগই। এ আসন থেকে দলটি কখনোই জয় পায়নি। উপনির্বাচনে পরাজয়ের ধারা সূচিত হলে নড়বড়ে হয়ে যাবে জাপার সাংগঠনিক ভিত। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করতে পারে শক্ত অবস্থান। ধারণা করা হচ্ছে, জাপার সাংগঠনিক ভিত দুর্বল করতেই কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে সরকার।

১৯৮৬ সালে সামরিক শাসনকাল থেকেই রংপুর সদর কব্জায় ছিল জাপার। তখন শফিউল গনি স্বপন নির্বাচিত হন এ আসন থেকে। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরাচার তকমা পাওয়া এরশাদের। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারাগারে বসেই রংপুর সদরসহ ৫টি আসনে নির্বাচন করে সবটাতেই জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও জয়ের ধারা বজায় রাখেন তিনি।

২০০১ সালের নির্বাচনে আইনগত বৈধতা না পাওয়ায় বিরত থাকতে হয় এরশাদকে। বিকল্প হিসেবে জি এম কাদের এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি তিনি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একটু ভুল সিদ্ধান্তে এ আসনে সাদ-আসিফ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফসল তুলতে পারে অন্যরা। আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে চেষ্টা তো করবেই, সমর্থন বাড়তে পারে বিএনপিরও। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, জাপা যদি নিজ ঘর থেকেই বিতাড়িত হয় তাহলে জাতীয় রাজনীতিতেও হারাবে শক্ত ভিত। দলটি যে বিস্ফোরোন্মুখ অবস্থায় রয়েছে সেখানে প্রভাব ফেলতে পারে রংপুরের উপনির্বাচন।

নগর জাপার সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচনের ফসল তুলতে বেগ পেতে হবে জাপাকে। এ ধ্রুব সত্য যত দ্রুত বুঝতে পারে দলটি ততই মঙ্গল তাদের!

 
Electronic Paper