ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লাঙ্গল বনাম হামার ছাওয়াল

শফিক হাসান
🕐 ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯

রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়েছে প্রচার-প্রচারণার জোয়ার। প্রার্থীরা যাচ্ছেন ভোটারের দ্বারে দ্বারে, তাদের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে দেখা যাচ্ছে নতুন উত্তেজনা ও প্রাণচাঞ্চল্য। জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্গ বলে পরিচিত এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘দুই ছাওয়াল’। একজন তার পুত্র সাদ এরশাদ, অন্যজন ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার। বিদ্যমান গৃহবিবাদে প্রচার-প্রচারণা ও বিষোদ্গারে এগিয়ে আসিফ। অন্যদিকে সাদও পিছিয়ে নেই। তবে কৌশলগত কারণে তার প্রচারণা চলছে নীরবে।

এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসন জাপাকে ফেলেছে নতুন চ্যালেঞ্জে। রংপুরবাসীর কাছে এরশাদ পরিচিত ছিলেন ‘হামার ছাওয়াল’ হিসেবে। যে কারণে নিজ এলাকার এ আসন থেকে এরশাদ বারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাপার যে প্রার্থীকেই এখানে মনোনয়ন দেওয়া হতো, দলীয় প্রতীকের জোরেই উৎরে যেতেন। সেই শক্তি ও সামর্থ্য বর্তমানের জাপার আছে কি-না, ‘ছাওয়ালের’ রাজনৈতিক প্রতীক লাঙ্গলে কতটা ভরসা রাখছেন ভোটাররা- সমীকরণ সহজ না হলেও কঠিন নয়।

দুই ধরনের মেরুকরণে দাঁড়িয়ে বর্তমানে জাপার স্থানীয় রাজনীতি। এ মেরুকরণের নাম ‘ভাই বনাম ভাই’, ‘দেবর বনাম ভাবি’, ‘কেন্দ্রীয় রাজনীতি বনাম আঞ্চলিক রাজনীতি’। বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত জাপায় আপাতত বড় কোনো ভাঙন কিংবা কোন্দল দেখা না গেলেও উপনির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতি নতুন মোড় নিতে পারে।

জাপা চেয়ারম্যান দেবর জি-এম কাদের এবং দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ভাবি রওশন এরশাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বই সাদকে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিয়েছে। তৃণমূল রাজনীতিতে যার কোনো যোগাযোগ নেই, সম্পর্ক নেই মাটি ও মানুষের সঙ্গে- সেই সাদ কীভাবে বহন করবেন জাতীয় পার্টির পতাকা! এ বিষয়ে প্রকাশ্য এবং চাপা ক্ষোভ রয়েছে দলের অনেকেরই। প্রথমে এ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুগ্মসচিব এস এম ইয়াসিরকে। পরে নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটে এরশন-রওশনপুত্রের। সাদ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রতি ইয়াসির বলেন, স্থানীয় অনেক যোগ্য নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকার পরও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দিয়েছে। এতে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। আমরা মহানগর ও জেলার নেতৃবৃন্দ সে আগুন প্রশমিত করার চেষ্টা করছি।

অন্যদিকে রংপুর সিটি করপোরেশন মেয়র (রসিক), কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার অবস্থান বিপরীতমুখী। তিনি বলেছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এ নির্বাচনী ক্যাম্পিংয়ে অংশ নিতে পারব না। আমি অসুস্থ। মনোনয়ন বোর্ডে ছিলাম না। কেন্দ্রীয়ভাবে যারা সাদকে দলের মনোনয়ন দিয়েছেন তারাই জানেন কীভাবে নির্বাচিত করবেন প্রার্থীকে। ‘এরশাদ ইমেজ’ কাজে লাগিয়ে সাদকে যদি জয়যুক্ত করতে পারেন তাহলে ভালো। তবে ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভোট লাঙ্গলের পক্ষে যাবে কি-না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন রসিক মেয়র।

ঘরে বাইরে সাদকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ইতিপূর্বে বিরোধিতা করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিলেন আসিফের কর্মী-সমর্থকরা। আসিফ নিজেও বিভিন্ন সময়ে সাদকে ভাড়াটিয়া, শিশু, বহিরাগত- এমন নেতিবাচক সম্বোধনে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর আসিফ শাহরিয়ার বলেছেন, সাদ এরশাদ বহিরাগত প্রার্থী। তাকে রংপুরের মানুষ কখনো দেখেনি, চেনেও না। ফলে বহিরাগত প্রার্থী লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও ভোটাররা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। আমি এরশাদ পরিবারের সন্তান। আমার প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন আছে। ফলে আমার প্রতীক লাঙল না হলেও মোটরগাড়ি প্রতীকে আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করবেন তারা।

অন্যদিকে জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা দাবি করে রংপুর জাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের মহাজোটের প্রার্থী সাদ এরশাদ। তার সঙ্গে শুধু জাতীয় পার্টি নয়, আওয়ামী লীগও আছে। আমরা রংপুরবাসী বারবার লাঙ্গল ও এরশাদকে ভোট দিয়েছি। এবার তার পুত্র সাদ এরশাদকেও বিপুল ভোটে জয়ী করব। প্রমাণ করব রংপুর মানেই এরশাদ ও লাঙল।

বস্তুত, এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রত্যাহার, বিএনপির তুলনামূলক ‘দুর্বল’ ও সমালোচিত প্রার্থীও সাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষুব্ধ প্রার্থীরা শেষপর্যন্ত আসিফকে সমর্থন দিতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ও কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আসামির স্ত্রী হিসেবে বিএনপির প্রার্থী রিটা রহমান সম্পর্কে রংপুরের মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটা শীষের প্রার্থীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালেও আশীর্বাদ হয়নি সাদের জন্য। তার জন্য ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ অভিধাও দুর্বল হয়ে যায়। ‘শত্রুতা’র মনোভাব কিংবা প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজের শক্তিশালী অবস্থান সংহত করা, ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়ার প্রচেষ্টা- কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না সাদের মধ্যে! ‘রংপুরের ছাওয়াল’ পরিচয়ে পরিচিত হতেও আন্তরিক নন ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ নেতা সাদ। যে কারণে রংপুরে পুরোদমে প্রচারণা শুরু হলেও সাদের পক্ষে জোরালো হাওয়া বইছে না। তার ক্যাম্পেইনেও দেখা যাচ্ছে মুষ্টিমেয় মানুষের উপস্থিতি।

ইসি থেকে প্রতীক বরাদ্দের সময় সব প্রার্থী নিজে উপস্থিত থেকে দলীয় প্রতীক নিলেও দেখা যায়নি সাদ কিংবা দলীয় কোনো নেতাকর্মীকে! তবে রিটার্নিং অফিসার তাদের দলীয় প্রতীক লাঙল বরাদ্দ দেন। দুইভাগে বিভক্ত রংপুরের রাজনীতির একাংশ মনে করছে, সাদ এরশাদ দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। ব্যক্তি নয়, এখানে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল প্রতীকই মুখ্য।

এ আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন- বিএনপি-জোটের প্রার্থী রিটা রহমান (ধানের শীষ), গণফ্রন্টের কাজী মো. শহিদুল্লাহ (মাছ), খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান ম-ল (দেয়াল ঘড়ি), এনএনপির শফিউল আলম (আম) এবং জাপার বিদ্রোহী প্রার্থী আসিফ শাহরিয়ার মোটরগাড়ি (কার)।

মোটরগাড়ির গতি বেশি নাকি লাঙ্গলের! বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, নির্বাচনী প্রতীক মোটরগাড়িতে চড়ে আসিফ যখন অনেক দূরে এগিয়ে যাবেন তখনও সাদ শক্ত মাটিতে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করবেন লাঙ্গলের ‘সুতীক্ষ’ ফলা। সে ফলা মাটি বিদ্ধ করার আগেই আসিফ পৌঁছে যাবেন সুদূরে। বাস্তবতা সেই ইঙ্গিতই দেয়। আসিফ শাহরিয়ার ইতিপূর্বে সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন। রংপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে রয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব ও পরিচিতি। তার বাবাও ছিলেন এমপি। এরশাদের ভাতিজা পরিচয়কে কাজে লাগাতে আসিফ বরাবরই কৌশলী ছিলেন।

জাপা বনাম জাপা, ভাই বনান ভাই দ্বন্দ্বের এ মিথস্ক্রিয়ায় জনসমর্থন শেষপর্যন্ত কোন দিকে যাবে, কে হাসবেন শেষ হাসি! সব উত্তর পাওয়া যাবে মাত্র একটি দিনেই- আগামী ৫ অক্টোবর। সত্যিকার অর্থের রংপুরবাসীর ‘ছাওয়াল’ কে পরীক্ষা হয়ে যাবে তারও!

 
Electronic Paper