ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এক পরিবার দুই প্রার্থী তিন মত

শফিক হাসান
🕐 ১০:২৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯

নাটকের নাম যদি হয় ‘রংপুর-৩ উপনির্বাচন’ তাহলে এর শ্রেষ্ঠাংশের অভিনেতা হিসেবে পাওয়া যাবে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরিবারের দুই সদস্যকে। তবে ‘শ্রেষ্ঠাংশের অভিনেতা’ হিসেবে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত এরশাদ-রওশনপুত্র সাদ এরশাদের দেখা মিলছে না তেমন, অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারের উপস্থিতি সবার চেয়ে বেশি। উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের মধ্যে প্রচার-প্রচারণা ও ‘শোরগোলে’ আসিফই এগিয়ে। ছোট ভাই সাদকে তিনি যেমন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্য প্রার্থীদের তেমন আমলে নিচ্ছেন না।

এক পরিবারের দুই প্রার্থীর বিষয়ে বলা যায় এটা ‘আংশিক রঙিন চলচ্চিত্র’। রঙিন দৃশ্যে দেখা মিলছে কেবল আসিফেরই। সাদাকালো ইমেজের বাইরে আসতে পারেননি সাদ। সাবেক রাষ্ট্রপতির পুত্র, বর্তমানে জাপার অন্যতম নেতা, সরকারের একাংশ রওশন এরশাদের প্রবল প্রতিপত্তিও কেন কাজে লাগাতে পারছেন না সাদ! তার নীরবতা, প্রচারবিমুখতায় স্থানীয় ভোটাররাও বিরক্ত। ভেতরে ভেতরে বিব্রত হচ্ছে জাপার হাইকমান্ড।

দেবর-ভাবির ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ আপাত বিজয়ী হয়ে পুত্রকে দলীয় মনোনয়ন দিতে সমর্থ হয়েছেন। ভাতিজাকে মনোনয়ন দিতে শুরু থেকেই অনীহা ছিলেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। অন্যদিকে সাদকে প্রকাশ্য সমর্থন ও বিপুল ভোটে জয়ের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম রাজু দলের পরামর্শে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও জাপার জন্য বড় বাধা দূর হয়েছে বলে ধরে নিয়েছে দলটি। এতে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু ফসল ঘরে তুলতে পারবে জাপা- সংশয় কাটেনি এখনো।

এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে আগামী ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের নেতাকর্মীরাই। দলীয় সমর্থন পেলে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রবল বাধার মুখে পড়েছেন সাদ। বস্তুত, তিন মতপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সাদ এরশাদ। একদিকে তার মা জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, অন্যদিকে চাচা জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, শেষ দিকে রয়েছেন রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা। চাচাতো ভাই আসিফ শাহরিয়ারকেও সমঝে না চলে উপায় থাকছে না। সাবেক সংসদ সদস্য আসিফ বিগত রসিক নির্বাচনে দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করেন এরশাদ। এর আগে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আসিফ। রংপুরে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দুটোই আছে। সব বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ের মালা পরতে পারেন আসিফই।

সাদকে নিয়ে জাপার একশ্রেণির মানুষ প্রকাশ্য উচ্ছ্বাস দেখালেও সেখানে প্রাণ নেই। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আসনটি ছেড়ে দিলেও এতটুকু পোক্ত হয়নি সাদের অবস্থান। বাড়েনি জনসমর্থন। তার প্রতি বিরক্ত স্থানীয় রাজনীতির কর্মীদের মনোযোগ ও সহানুভূতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন; বলা ভালো, সাদ সেই চেষ্টাই করেননি! ভুঁইফোড় নেতা হিসেবে জনসমর্থন নেই, তেমনি নেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও। গণসংযোগেও পিছিয়ে সাদ। এমতাবস্থায় এক পরিবারের দুই প্রার্থীসহ তিনটি মতের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রংপুরের রাজনীতিতে জাপার ভবিষ্যৎ।

বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, নির্বাচনের পরপরই জাপাতে আসতে পারে বড় ধরনের ভাঙন। বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ দলের নিয়তি ভাঙনই। কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে কত টুকরো হবে; বানরের পিঠা ভাগের মতো জাপার ভাগ হওয়া দলটির জন্য অশনি সংকেত হলেও ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রশ্নে তাতে ভ্রূক্ষেপ করছেন না নেতারা। বৈধ চেয়ারম্যান কে- ক্ষমতার ভাগাভাগিতে দেবর-ভাবির এমন দ্বন্দ্বে নতুন করে জাপা দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। প্রকাশ্যে এসেছে কাদেরপন্থী ও রওশনপন্থী কয়েকজন নেতার সম্পর্কে ফাটল। ভাঙনকবলিত, এরশাদবিহীন টালমাটাল জাপায় সাদের দিকে পরিপূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সদিচ্ছা নেই অনেকেরই। যা চলছে তা কেবলই নিয়ম রক্ষা!

এরশাদের বাড়ি এ আসনেই। বরাবরই এটি পরিচিত ছিল জাপার দুর্গ হিসেবে। সেই সংস্কৃতি এবার পাল্টে যাবে কিনা, দল বনাম দল বিষয়টি সামনে চলে আসবে কিনা-টানটান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ‘অচেনা, অজানা’ সাদকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষেপেছেন স্থানীয় ভোটাররা। তার পর আবার রয়েছে আসিফের সমর্থকদের শক্ত প্রতিরোধ; আসিফ কর্তৃক ‘ভাড়াটিয়া’ ও অপবাদ এবং ডিএনএ পরীক্ষার দাবি সব মিলিয়ে জাপার রাজনীতি পৌঁছেছে ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সাদের প্রতি বিমুখ ভোটাররা ঝুঁকতে পারেন আসিফের দিকে। আসিফ কিংবা অন্য যে প্রার্থীই এ আসন থেকে জয়লাভ করুন- সেটা হবে জাপার জন্য ‘উদ্বাস্তু’ হওয়ার সময়। মত-পথ ডিঙিয়ে কত দূরে যাবে জাপা, কোন তরিকায় পৌঁছবে গন্তব্যে- পরিকল্পনা এবং উত্তরণের সুযোগ এখনো বয়ে যায়!

 
Electronic Paper