কে হচ্ছেন আ.লীগ সম্পাদক
কুন্তল দে
🕐 ১১:০৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল আগামী ২১ ও ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। বরাবরের মতো সম্মেলনে দলটির দ্বিতীয় শীর্ষ পদ সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। এরই মধ্যে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নজর কাড়তে তোড়জোড় শুরু করেছেন অনেক নেতা। শেষপর্যন্ত কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে তা একমাত্র আওয়ামী লীগ প্রধানের ওপরই নির্ভর করছে বলে একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদ ঘিরেই নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভেতর থাকে মূল আগ্রহ। এবারের কাউন্সিলেও এর ব্যতিক্রম নয়। এ নিয়ে সব স্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে চলছে সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার এ মিছিলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতা মতিয়া চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলের প্রয়োজনে আরও নবীন কোনো নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে বসাতে পারেন।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর ২০তম সম্মেলন হয় আওয়ামী লীগের। ওই সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়, যার সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ওই কমিটির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জে উতরে যাওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে যে ইশতেহার ঘোষণা করে তার আলোকেই নতুন নেতৃত্ব গড়তে ২১তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।
সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনা ও তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ২০২১ সাল স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও ২০২০ সাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। বাঙালি জাতি ও আওয়ামী লীগের জন্য চূড়াস্পর্শী এ দুটি মাইলফলক। ফলে নতুন যে কমিটি হবে সেই নেতৃত্বকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর কঠিন এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে যিনি দলকে সুশৃঙ্খল রাখতে পারবেন তাকেই আওয়ামী লীগপ্রধান সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে আনবেন।
ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও দলটির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। ৭০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় এ পর্যন্ত দলটির ২০টি সম্মেলন হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগে চারবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই বা এর বেশিবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। দলটির ইতিহাসে আবদুল জলিল একবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বিবেচনা করলে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ফের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে আসার সম্ভাবনাই বেশি। এ ক্ষেত্রে তার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা শারীরিক অসুস্থতা। গত মার্চ মাসে হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাক হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। সেখানে তার সফল অস্ত্রোপচার হয়। সিঙ্গাপুরে দুই মাস দশ দিন চিকিৎসার পর দেশে ফেরেন তিনি। ৬৭ বছর বয়সী এই নেতাকে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বড় একটা হার্ট অ্যাটাক এবং বাইপাস সার্জারির ধকল কাটিয়ে ওবায়দুল কাদের যেভাবে ও যত দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন তা বিস্ময়কর। দলের নানা সমস্যা দেখভালের পাশাপাশি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম মন্ত্রণালয় দেখভাল করছেন তিনি। অসুস্থতাজনিত ধকল থাকা সত্ত্বেও সবকিছুই দারুণভাবেই সামলাচ্ছেন। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার প্রথম পছন্দও তিনি। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি আবার এ পদে আসতে কিছুটা দ্বিধান্বিত। এ ঝুঁকি বিবেচনা করেই দ্বিতীয়বারের মতো তাকে সাধারণ সম্পাদক পদে নাও আনতে পারেন শেখ হাসিনা।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের দলের সভাপতি ও পার্টির সুপ্রিম শেখ হাসিনা। কাউন্সিলে কাউন্সিলররা নেত্রীর মাইন্ড সেটের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেন। দলের সাধারণ সম্পাদক সভাপতির নির্দেশ অনুযায়ী চলেন। আরেকবার সাধারণ সম্পাদক হবো কি-না, তা নেত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি বললে থাকব, না বললে সরে যাব। তবে এই পদে যে-ই আসুক আমি তাকে স্বাগত জানাই।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনে সবকিছু পূর্ণ হয় না। আমার আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। অসুস্থতার পরও দল এবং সরকারের দায়িত্ব পালন করেছি, সময় দিয়েছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী তিন বছরে আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের পরিকল্পনা তা সুসম্পন্ন করার জন্য সভাপতির আস্থাভাজন, ডায়নামিক ও নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সাধারণ সম্পাদক প্রয়োজন। গত কয়েকটি সম্মেলনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
২০০২ সালের কাউন্সিলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০০৯ সালের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের কাউন্সিলে তাকে পুনঃনির্বাচিত করা হয়। ওই কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরকে ২০১৬ সালের সর্বশেষ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
আসন্ন কাউন্সিলে ওবায়দুল কাদের ছাড়াও মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, দীপু মনি ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম সর্বাগ্রে আলোচিত হচ্ছে। সূত্র বলছে, এক সময়ের ডাকসুর ভিপি ও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি মতিয়া চৌধুরীকেও দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে পারেন শেখ হাসিনা। সাবেক এ মন্ত্রী আওয়ামী প্রধানের আস্থাভাজনদের একজন। এ ছাড়া ক্লিন ইমেজের কারণে দলে সমাদৃতও তিনি। তবে বয়স এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।
প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও স্বচ্ছ ইমেজের জন্য সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। এক সময়কার ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক কৃষক ও সাধারণ মানুষের পক্ষে নানা সময়ে কথা বলেছেন। তবে মন্ত্রী হওয়ার পর বোরো ধানের দাম নিয়ে কৃষকের যে সংকট সৃষ্টি হয় তা সামলাতে অনেকটা ব্যর্থ হওয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এরপরও নানা কারণেই দলীয়প্রধানের গুডবুকে আছেন তিনি।
সরকার থেকে দলকে আলাদা করার নীতি যদি এবারের কাউন্সিলে নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তিনি স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও এগিয়ে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে। এক-এগারো পরবর্তী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুদায়িত্ব পালন করে দলীয়প্রধানের আস্থাভাজন হন তিনি। ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতার সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এবারের মন্ত্রিসভাতেও না থাকা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ও আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনিকে সাধারণ সম্পাদক পদে এগিয়ে রাখতে চান অনেকে। আওয়ামী লীগের প্রতি নিবেদিত, পরিশ্রমী ও স্বচ্ছ ইমেজের কারণে দল ও দলের বাইরে সবখানেই প্রশংসিত তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শিক্ষার কলঙ্ক প্রশ্ন ফাঁসের রাহু থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কাজ দিয়েই আওয়ামী প্রধানের আস্থাভাজন তিনি। তবে কাউন্সিলে সরকার ও দল আলাদা করার নীতি বাস্তবায়ন হলে দীপু মনি পিছিয়ে থাকবেন।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানকের নামও শোনা যাচ্ছে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। একাদশ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটিতে তাকে রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া ছাত্রলীগসহ দলের নানা বিষয়ে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। ছাত্রলীগ দেখভালে ব্যর্থ হওয়ায় তার ওপর দলীয়প্রধান কিছুটা নাখোশ। এরপরও সরকার ও দল পৃথক করার নীতি নেওয়া হলে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন তিনি।
এর বাইরেও নতুন নেতৃত্বের চমক হিসেবে বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও এএফএম বাহাউদ্দিন নাছিমকেও এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনেই গড়ে ৩০ ভাগ নতুন মুখ আসছে। জাতীয় সম্মেলনেও নেতৃত্বে অনেক নতুন মুখ আসবে। ভবিষ্যৎ দলের কথা বিবেচনা করেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দেওয়া হচ্ছে।’
সূত্র বলছে, দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য রাখতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত কয়েক বছরে বারবার তিনি নতুন নেতৃত্বের কথা বলেছেন। দলকে শক্তিশালী করা, তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে আরও বিস্তৃত করা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য গতিশীল সংগঠন গড়ে তুলতে চান তিনি।
দেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্যও সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম এমন নেতৃত্বের হাতেই তুলে দিতে চান দলের দায়িত্ব। তবে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে আওয়ামী লীগ প্রধানের নজর কাড়তে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন অনেক নেতাই।