ছাত্রলীগের নিয়োগ বাণিজ্যে উত্তপ্ত ইবি
ইবি প্রতিনিধি
🕐 ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কমিটি স্থগিত, দুই সদস্যের কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে সম্মেলন ছাড়াই অর্থের বিনিময়ে ফের দুই সদস্যের কমিটি গঠন, কেদ্রীয় কমিটিতে কোনো প্রতিনিধি না রাখা এবং ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় (ইবি) ছাত্রলীগের রাজনীতি।
রোববার এসব অভিযোগে বিক্ষোভ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ শেষে এক সমাবেশ থেকে তারা শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেন ও নিয়োগ বাণিজ্যের একাধিক অডিও প্রকাশ পাওয়ায় বর্তমান কমিটিকে বিলুপ্ত করে নতুন করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানান।
সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে এক ব্যক্তির দু’টি কথোপকথনের অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। একটিতে তিনি নিজেকে ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অঞ্চলিক প্রতিনিধি দাবি করে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে মাহমুদুল হাসান নামের এক শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে পদে বসানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে গত কমিটি ভেঙে দিয়ে কমিটিতে পদ নেন এবং ৬ মাসে এ টাকা দ্বিগুণ করতে সক্ষম হবেন। আর সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে একইভাবে তিনি আরও কমিটি করে দিতে পারবেন।
আরেকটি অডিও ক্লিপে একজন ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করেন। এসব বিষয়ে খোলা কাগজসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রচারিত হলে সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্ট হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিপুল আর্থিক লেনদেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছ থেকে চাঁদা দাবিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কমিটি থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এত বড় ঘটনার অন্যতম কুশীলব ইবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেনের কোনো শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ অনেকেই।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলা বিভাগের ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহিনুর রহমান শাহিনকে সভাপতি এবং একই বিভাগের ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা হালিমকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় প্রায় অর্ধশতাধিক পদ প্রত্যাশী থাকা সত্ত্বেও মাত্র দুই সদস্যের কমিটি গঠন করাতে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সে সময় অল্প দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সকলের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে এই কথা বলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে কার্যক্রম চালান কমিটির শীর্ষ দুই নেতা।
কিন্তু কমিটি গঠনের ১ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে গত বছরের ২৭ অক্টোবর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার জন্য কেন্দ্রে জমা দিতে গেলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চান না’ বলে কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিই স্থগিত করা হয় বলে জানান স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা হালিম।
এদিকে কমিটি স্থগিত থাকার প্রায় ৮ মাস পর কোনো রকম সম্মেলন ছাড়াই চলতি বছরের ১৪ জুলাই ইংরেজি বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম পলাশকে সভাপতি এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সাধারণ সম্পাদক করে ফের দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি নতুন কমিটি করে দেন সদ্য বিদায়ী কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী। পুরাতন কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে দুই সদস্যের নতুন কমিটি দেওয়ায় ছাত্রলীগের দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসা ত্যাগী এবং বঞ্চিতরা ক্ষোভ এবং হতাশা প্রকাশ করেন।
পদবঞ্চিত কর্মী সাইদুর রহমান বাবু বলেন, ভর্তি হওয়ার পর থেকে শিবিরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। এখনও শরীরে বুলেট বহন করছি। গত সপ্তাহে আমার শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। গত কমিটিতে পদ না পেলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলে একটি সম্মানজনক পদ পাব বলে আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কিন্তু কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে কেন্দ্র আবার একটি দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে দেওয়ায় হতাশ হয়েছি। ভবিষ্যতে রাজনীতি করার ইচ্ছে ছিল। পদ না পাওয়ায় এখন এলাকায় গিয়ে নিজেকে কী পরিচয় দিব? এমন সংস্কৃতি চলতে থাকলে নতুন করে যারা ছাত্রলীগ করবে তাদের মধ্যেও এর একটি খারাপ ধারণা তৈরি হবে। এটি কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। আর যখন জানতে পারলাম ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্য অধিকার বিক্রি হয়েছে তখন একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে লজ্জা পাই। আমি এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেই সঙ্গে এই অবৈধ কমিটিকে বাতিল করে পরীক্ষিতদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সবসময় অবহেলা করে। এটা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতো তাহলে কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে টাকার বিনিময়ে আরেকটি কমিটি গঠন করতে পারতেন না। তাছাড়া ওই নেতা দাবি করেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে সেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সহ বিভিন্ন সরকারি কলেজ এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতা কর্মীদের ভালো ভালো পদ দেওয়া হলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নেতাকর্মীকে সদস্য পদও দেওয়া হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে ছাত্রলীগের তৃণমূলের রাজনীতি ধ্বংস হবে। ছাত্র রাজনীতি চলে যাবে হাইব্রিড এবং সুবিধাভোগীদের দখলে। যা ছাত্রলীগের তৃণমূলকে রাজনীতি থেকে নিরুৎসাহিত করবে।
বিদায়ী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা হালিম কমিটি স্থগিত, পূর্ণাঙ্গ হতে না দেওয়া এবং নতুন কমিটিকে গঠনকে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপকে দুষছেন।
তিনি বলেন, আমি যতবার কমিটি পূর্ণাঙ্গ ও বহালের বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছি ততবার জানানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার এবং প্রক্টর স্যার চাননা এ কমিটি থাকুক। এ ছাড়া বর্তমান যে দুজনকে ইবি ছাত্রলীগের পদে বসানো হয়েছে তারা প্রশাসনের পকেট কমিটি ছাড়া কিছু নয়। অনুগত ছাত্রলীগের নতুন কমিটিকে বর্তমান প্রশাসন তাদের শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়গুলো ঢাকতে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ৫৩৭ কোটি টাকা লোপাট করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি রবিউল ইসলাম পলাশ বলেন, আর্থিক লেনদেনের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এটা সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামের একক বিষয়। তিনি কার সঙ্গে কী বিষয়ে এসব বলেছেন আমি অবগত নই। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসছি। এর আগের কমিটিতেও আমি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার বিরুদ্ধে কেউ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আনতে পারলে আমি নিজ থেকেই সরে দাঁড়াব।
অভিযুক্ত ইবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অডিও ক্লিপটি আমার নয়, আমি স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তের শিকার।
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিষয়।