ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জাবি ভিসি বনাম শোভন-রাব্বানী

কে সত্য কে মিথ্যা

প্রসঙ্গ চাঁদাবাজি

সুলতান মাহমুদ ও সনজিৎ সরকার
🕐 ১১:০৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার মেগা প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান শোভন ও রাব্বানী। এখন তদন্তে বেরিয়ে আসবে কার কথা সত্য এবং কি পরিমাণ অর্থ চাঁদা হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে ও গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেছেন, জাবি ভিসি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন এবং তার স্বামী ও ছেলে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে ‘কমিশন বাণিজ্যে’ জড়িয়েছেন। তবে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম রাব্বানীর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উপাচার্য তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে। এ বিষয়ে তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেছেন। আর ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও আচার্যকে অনুরোধ করবেন বলেও জানান।

তিনি দাবি করেছেন, রাব্বানী বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নানা দাবি-আবদার করেছে। সেসব পূরণ না হওয়ায় হতাশ হয়েই এসব কথা বলছে। জাবি ভিসি বনাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এখন সবার কাছে জানার আগ্রহ জেগেছে কে সত্য বলছেন, জাবি ভিসি নাকি ছাত্রলীগ নেতারা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত ৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের ৪-৬ পারসেন্ট চাঁদা দাবি করেন।

উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে-এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। কিন্তু ভিসি তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রুঢ় আচরণ করেন বলে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

ভিসি বলেছেন, সেদিন তারা (শোভন ও রাব্বানী) আমাকে বলে, এত বড় প্রকল্প, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। আপনি কোম্পানিগুলোকে বলে দেন তারা যেন আমাদের কিছু (পার্সেন্ট) টাকা দেয়। আমাদের টাকা দিলে আমরা স্থানীয় (জাবি) ছাত্রলীগকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেব। কিন্তু আমি তাদের কথায় রাজি হইনি এবং মুখের ওপর বলে দিয়েছি, আমি কোনো টাকা-পয়সার মধ্যে নেই। তখন তারা আমাকে বলল আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। সে জন্য আপনার কাছে এসেছি। তখনো তাদের কথায় সাড়া না দেওয়ায় তারা আমার সঙ্গে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলা শুরু করে। এর কিছু সময় পর তারা চলে যায়।

তারা কত পার্সেন্ট দাবি করেছিল, এমন প্রশ্নে ভিসি বলেন, ‘দু-এক পার্সেন্ট না, তারা চার কিংবা ছয় পার্সেন্টের কথা বলেছিল। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিসি ফারজানা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’

এদিকে ভিসি শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার যে অভিযোগ গোলাম রাব্বানী তুলেছেন তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা। তিনি বলেন, রাব্বানী ভাই আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এসব কথা বলেছেন। তিনি যেখান থেকে তথ্য পেয়েছেন, সেটি ভুল তথ্য ছিল। এটি ভাইয়ের তথ্যগত ভুল। টাকা পাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে জাবি থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগের যুক্তি খণ্ডাতে গত বুধবার ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রাব্বানী বলেন, বিষয়টি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপাচার্য ম্যামের স্বামী ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে কাজের ডিলিংস করে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল আজহার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন।

এ খবর জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হয় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ম্যাম আমাদের স্মরণ করেন। আমরা দেখা করে আমাদের অজ্ঞাতসারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়ার প্রশ্ন তোলায় তিনি বিব্রতবোধ করেন। নেত্রী, উক্ত পরিস্থিতিতে আমরা কিছু কথা বলি যা সমীচীন হয়নি। এজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

রাব্বানীর এ বক্তব্যের বিষয়ে ভিসি ফারজানা ইসলাম বলেন, চাওয়া-পাওয়া পূরণ না হওয়ায় হতাশ হয়ে তারা এসব মানহানিকর কথাবার্তা বলছে। তারা দুজন ৮ আগস্ট আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তারা প্রকল্প থেকে ৪-৬% টাকা দাবি করে। ৬% টাকা অর্থাৎ ৮৬ কোটি টাকা।

ভিসি আরও বলেন- প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদের (শোভন-রাব্বানী) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের টাকা দিলে তারা নাকি স্থানীয় ছাত্রলীগকে সেখান থেকে ভাগ করে দেবে। তখন আমি বলি, যদি সেরকমই হয়ে থাকে তাহলে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছেই টাকা দিই; তোমরা সেখান থেকে নাও। তারা আমার কথায় হতাশ হয়। এর আগে আমি বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায়ও তারা দেখা করতে যায় আমার সঙ্গে। তখন তারা তিন বা চারটি হলের টেন্ডার তাদের দিতে বলে। আমি তাদের না করে দিই। তখন দেখা করতে গিয়েও তারা ঝামেলা তৈরি করেছে। সেখানে একই ফ্লোরে বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসাধীন ছিলেন। তারা ২০-২৫ জনের বিশাল বহর নিয়ে সেখানে হাজির হয়। এটা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে। আমিও বিব্রত হই।

ভিসি বলেন, তারা বিভিন্ন সময় প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাদের কর্মকর্তাদেরও ডিস্টার্ব করে টাকার জন্য। এখন এসব কথা বলে তারা আমার পরিবারের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, জাবি ছাত্রলীগের সদস্যরা এসে আমাকে পুরো ব্যাপারটি জানিয়েছে। জাবিতে এমন কেউ নেই যারা বিষয়টি জানে না। ক্যাম্পাসের প্রত্যেকেই পুরো ঘটনাটি জানে। তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে আমি এবং শোভন উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করি এবং বলি, ম্যাম, আপনি তাদের টাকা দিয়েছেন। তাহলে আমাদের ন্যায্য পাওনা কই? আমাদের ঈদ বোনাস কই? জাবি প্রশাসন আমাদের কোনো টাকা না দিলেও আমাদের নেতৃত্বের নিচে যারা রয়েছে তাদের টাকা দিয়েছে। জাবি ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শোভন বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টেন্ডারের ভাগ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে জানতে পেরে আমরা উপাচার্যের কাছে বিষয়টি জানতে চাই। এখানে আমাদের চাঁদাবাজির কোনো বিষয় ছিল না। আমরা ঘটনা জানার চেষ্টা করার পর থেকেই উপাচার্য ম্যাডাম কী কারণে ক্ষিপ্ত হয়েছেন জানতে পারি নাই। আমরা বিষয়টি জানতে চাই।

এদিকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে চলমান আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জাবি সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম পাপ্পু বলেছেন, ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ত্রিমুখী স্ববিরোধী বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় এই উন্নয়ন পরিকল্পনার ভেতর শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেহেতু সংবাদপত্র মারফত খবরগুলো এসেছে তাই আমরা এখনো চাচ্ছি সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা হোক। যেহেতু আলোচনায় প্রশাসন তিন কার্যদিবস সময় নিয়েছিল কিন্তু এরপর খবরগুলো ঘটনাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আমাদের আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা আমরা দেইনি তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় আসতে পারে। আমরা সজাগ আছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এর তদন্ত চেয়ে আন্দোলনকারীদের একজন হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারেক রেজা। তিনি বলেছেন, আমি মনে করি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য ভিত্তিহীন নয়। উপাচার্য ও তার স্বামী-পুত্রের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড, টেন্ডার ছিনতাইয়ের তদন্ত ও বিচার না হওয়া, জাবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বক্তব্য ও আচরণ উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে আরও নিশ্চিত করেছে। তিনি উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। একমাত্র তার পদত্যাগই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কমুক্ত করতে পারে।

 
Electronic Paper