ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মহাসংকটে এরশাদ পরিবার

মুখোমুখি আসিফ-সাদ

শফিক হাসান
🕐 ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতির প্রাণসঞ্চারী ব্যক্তি দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর দুই মাস পূর্ণ হলো আজ শনিবার। এ দু’মাসেই দলে যে উত্থান-পতন, নাটক-পাল্টা নাটক সংঘটিত হলো, তা খুব একটা অনাকাক্সিক্ষত কিংবা অপ্রত্যাশিত ছিল না। পুঞ্জীভূত মেঘ যে কোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে এমন আলামত সংশ্লিষ্টরা পেয়েছিলেন এরশাদের জীবদ্দশাতেই। তার মৃত্যুর পর আরও স্পষ্ট হয়েছে জাপার ‘পারিবারিক রাজনীতি’র মেরুকরণ। পরিবারটি বর্তমানে মহাসংকটে রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে, যদি দলটি ঐক্য ধরে রাখতে না পারে।

জাপা যে ঐক্যের পথে নেই সেটা স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি দুই প্রজন্মের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে। শুরুতে বড় ধাক্কা দিয়েছিলেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ এবং এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব ফের সামনে চলে আসে। প্রশ্ন তোলা হয়- জাপার বৈধ চেয়ারম্যান কে! এরশাদের জীবদ্দশায় যে প্রশ্নের সুরাহা হয়নি, মৃত্যুর পর সেটিকে ঘিরে জল আরও ঘোলা হবে- এমনটাই ছিল ‘স্বাভাবিক’।

রওশন নিজ পুত্র সাদ এরশাদকে রংপুরে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করতে চাইলেও কাদেরের পছন্দ ছিল অন্য প্রার্থী। ঠিক একই সময়ে জাপার সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের স্বাক্ষর নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন নিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলেন কাদের। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মনোনয়ন পেতে সে চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা চিঠি পাঠান রওশন। একপর্যায়ে বিদ্যমান সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। সিদ্ধান্ত হয় দলের চেয়ারম্যান থাকবেন কাদেরই, রওশন হবেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা; তার আগেকার পদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করবেন কাদের। অন্যদিকে রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী হবেন এরশাদ-রওশনপুত্র সাদ এরশাদ।

এ দ্বন্দ্বের আপাত সমাধান হলেও স্পষ্ট হয়ে গেছে জাপা অলিখিতভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ রওশনপন্থি, অন্যপক্ষ কাদেরের প্রতি সহানুভূতিশীল। রওশনকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং ইন্ধন দিয়ে একটি পক্ষ চেয়েছিল ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে। সেটা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে গেলেও এ পক্ষ যে নতুন করে অন্য কৌশলে জাল বিস্তার করবে না এমনটা ভাবার কারণ নেই। এর মধ্যে আবার মহাসচিব রাঙ্গার ভূমিকাও ধোঁয়াশাপূর্ণ। বোঝা যাচ্ছে না, ঠিক কোন দিকে ‘হেলে’ আছেন তিনি। একটি পক্ষ মনে করে, সরকারের ‘এজেন্ডা বাস্তবায়নে’ও ভূমিকা রাখতে পারেন রাঙ্গা। আওয়ামী লীগ যদি চায় জাপার ভাঙন সেক্ষেত্রে রাঙ্গাই হতে পারেন ট্রাম্পকার্ড!

কেন্দ্রীয়ভাবে এরশাদ পরিবার যেমন বিভক্ত, স্থানীয়ভাবেও পরিবারটি যে ‘একান্নবর্তী’ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। রংপুর-৩ আসনে জাপার প্রার্থী হিসেবে প্রথমে এস এম ইয়াসিরের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে সেখান থেকে সরে আসে হাইকমান্ড। রওশন ও দলের একাংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় সাদ এরশাদকে। কিন্তু আগে থেকেই এ আসনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করে আসছিলেন এরশাদ ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার। সাদের রাজনীতিতে আসা ভালোভাবে নেননি তিনি।

চলতি মাসের ৩ তারিখে রংপুরে সাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন আসিফ সমর্থক নেতাকর্মীরা। একটি পক্ষ সাদকে ‘শিশু’ ও ‘ভাড়াটিয়া’ হিসেবে অভিহিত করেন। আসিফ শাহরিয়ার সাদের আগমন প্রতিহত করতে তার ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানান। জন্ম থেকেই সাদকে নিয়ে একধরনের প্রশ্ন ও ধোঁয়াশা ছিল। তিনি আসলেই এ দম্পতির সন্তান কি-না, নাকি গোপনে পালিত নানা মহলে ছিল এর ‘যৌক্তিক’ জিজ্ঞাসা। কিন্তু ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের দাবি এবারই এসেছে প্রথম। রাজনৈতিক লাভালাভে এক ভাইয়ের প্রতি অন্য ভাইয়ের এমন আচরণকে অশোভন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বর্তমানে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্তা। তিনিও ঘোর সাদবিরোধী। সাদকে এ আসনে কেউ ভোট দেবে না বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। মোস্তফার সমর্থন না পেলে এ আসনে সাদ কতটা কামিয়াব হবেন এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাপার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরে এরশাদ ম্যাজিক অনেকটাই তিরোহিত। নিজেদের ‘ছাওয়াল’ মারা যাওয়ার পর পারিবারিক কোন্দল ও ক্ষমতার ভাগাভাগিকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না স্থানীয়রা। বর্তমানের কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে তারা বিরক্ত ও বিব্রত। বিশেষ করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ চাইছেন দলে ঐক্য টিকে থাকুক।

পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাপা যে সংকট সৃষ্টি করেছে তা নিরসন হবে কোন পন্থায়- আশার আলো দেখছেন না বিশ্লেষকরা। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক এবং এ দম্পতির সন্তান এরিক এরশাদও রয়েছেন ‘পারিবারিক’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিভিন্ন সময়ে প্রচারমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিদিশা ইঙ্গিত দিয়েছেন জাপা নিয়ে তার আগ্রহের কথা। এরশাদ ট্রাস্টে এরিকের অন্তর্ভুক্তি এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতারই ইঙ্গিত দেয়। বর্তমানে এরশাদপুত্র এরিক ও সাবেক স্ত্রী বিদিশা একপ্রকার নীরবতা পালন করছেন। এ নীরবতা কখন আবার ‘সরব’ হয়ে ওঠে তা নিয়েও রয়েছে কৌতূহলের দোলাচল। অতীতে জাপার রাজনীতিতে ‘টনিক’ হয়ে ওঠা বিদিশা কিংবা এরিক রাজনীতিতে নাম লেখালে তা যে এরশাদ পরিবারকে আরও বড় গৃহবিবাদের দিকে এগিয়ে নেবে বলার অপেক্ষা রাখে না।

বর্তমানে এক লাঙ্গল নিয়ে দুই ‘কৃষকের’ টানাহেঁচড়া যেভাবে চলছে তা ‘চাষ’ কতটা ভালো হবে! অতীতেও বেশ কয়েকবার ভেঙেছে জাপা। দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘লাঙ্গল’ কার তা সুরাহা করতে দৌড়াতে হয়েছে আদালত পর্যন্তও। এ লাঙ্গল আর কতদিকে কর্ষণ করবে, রাজনীতির ‘অবারিত ভূমি’তে কত জনের হাতে শোভা পাবে! মূলত এরশাদের প্রভাবে টিকে থাকা জাপার কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে চলতি বছরের শেষের দিকে। এ কাউন্সিলকে ঘিরেও দলে বিরোধ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

জাপার নীরব ও সরব যুদ্ধংদেহি প্রবণতা দলটিকে ভাঙনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরশাদ পরিবারের দেবর-ভাবির যুদ্ধে জয়ী কে? রওশনপন্থিরা এটাকে জয় মনে করে উল্লসিত হলেও বিশ্লেষকরা করছেন অন্য হিসাব! ক্ষমতার কামড়াকামড়ি প্রকৃতপক্ষে দলের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কি-না তা অনুধাবন করতে অপেক্ষায় থাকতে হবে আর মাত্র ক’টা দিন!

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী রংপুরের এ এ উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ অক্টোবর।

 
Electronic Paper