ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এরশাদের শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনয়ন

জি এম কাদেরের এসিড টেস্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:১৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৯, ২০১৯

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়েছেন জিএম কাদের। সে অগ্নিপরীক্ষা শুরু হচ্ছে নিজেদের ঘাঁটি রংপুর থেকেই। দলের অভ্যন্তরে সব ধরনের বিভক্তি এড়িয়ে, সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে সন্তুষ্ট করে এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপ-নির্বাচনে যোগ্য ও উইনেবল প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়াটাই এখন জিএম কাদেরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দলীয় নেতাকর্মীরাও বলছেন, এটা দলের নতুন চেয়ারম্যানের জন্য এসিড টেস্ট। এ যাত্রায় যদি তিনি উৎরে যান তাহলে তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ যেমন দিতে পারবেন তেমনি তার প্রতি দলীয় নেতাকর্মীদের নির্ভরতাও বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরশাদ বেঁচে থাকতেই জাপায় দুটি বলয় সক্রিয় ছিল। তার একটির নেতৃত্বে স্বয়ং এরশাদ এবং অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন এরশাদপত্নী ও দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। মৃত্যুর আগে এরশাদ ভাই জিএম কাদেরকে দলের উত্তরসূরি মনোনীত করায় রওশনপন্থী অংশটি অসন্তুষ্ট। দুই বলয়ের বিভেদ প্রকাশ্য হওয়ার পর অনেকেই দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আরও এক দফা ব্র্যাকেটবন্দি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে জাপা। এ অবস্থায় দলের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের সামনে দলের ঐক্য টিকিয়ে রাখা এবং বিভক্তির চারা উপড়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জও দাঁড়িয়ে আছে।

এ অবস্থায় রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত দলকে ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। একটি ভুলের মাসুল দিতে হবে সারা জীবন। এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া আসনটিতে আগামী ১ বা ২ অক্টোবর ভোটগ্রহণের কথা ভাবছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এ আসনটি নিজেদের কর্তৃত্বে রাখতে মরিয়া কাদের ও রওশন বলয়। এ ছাড়া রংপুর সিটি করপোরেশন মেয়র জাতীয় পার্টির মহানগর সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে ঘিরে গড়ে ওঠা দলের আঞ্চলিক বলয়টিও চাইছে আসনটি তাদের কর্তৃত্বে থাকুক। এ আসনের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলের অভ্যন্তরে চলছে নানা তৎপরতা।

এদিকে জাপার দুর্গ হলেও এ আসনে জাপাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মহাজোটের কয়েকটি দল এবং বিএনপিও। ইতিমধ্যে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠেও নেমে গেছেন। বিএনপি নেতা হাবিব উন নবী খান সোহেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজ্জাফর হোসেন বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে মনে করছেন স্থানীয় মহল। আওয়ামী লীগ থেকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং জেলা নেতা অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম রাজুর নাম শোনা যাচ্ছে।

অপরদিকে জাতীয় পার্টি থেকে এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ, এরশাদের আমেরিকা প্রবাসী ছোট ভাই ড. হুসেইন মুর্শেদ, এরশাদের ভাতিজা জাপা থেকে বহিষ্কৃত আসিফ শাহরিয়ার এবং এরশাদ পরিবারের বাইরে রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, রংপুর মহানগর সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির ও জেলা জাপা নেতা আব্দুর রাজ্জাকের নাম শোনা যাচ্ছে।

দলীয় সূত্র বলছে, রওশন এরশাদ চাইছেন ছেলে সাদ এরশাদকে ওই আসনে মনোনয়ন দিতে। কিন্তু স্থানীয় নেতারা বলছেন রংপুর সদর আসনের মানুষের সঙ্গে সাদের কোনো যোগ নেই। এরশাদপুত্র হিসেবে সাদের নাম শুনলেও রংপুরের জনগণ সাদকে ভালোমতো চেনেন না। এমনকি এরশাদ জীবদ্দশায়ও সাদকে রংপুরের মানুষের সঙ্গে কখনো পরিচয় করিয়ে দেননি। কখনো তার নাম মুখে নিতেও শোনেনি। বরং এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ সাদের চেয়ে অনেকটা জনপ্রিয়। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এরশাদ এরিককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

এরশাদের প্রবাসী ভাই হুসেইন মুর্শেদের ব্যাপারে জাপার একটি অংশ আগ্রহ দেখালেও রংপুরের মানুষের তেমন একটা আগ্রহ নেই তার ব্যাপারে। ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার মনোনয়ন চাইতে পারেন, এমনটা শোনা গেলেও জাপা নেতারা বলছেন, তিনি বহিষ্কৃত। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এরশাদের মনোনীত মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার বিরোধিতা করে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। ফলে জাপার টিকিট তার ভাগ্যে আর জুটবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এরশাদের পরিবারের বাইরে কাউকে মনোনয়ন দিলে স্থানীয় নেতাদের কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বিবেচনায় আছেন স্থানীয় নেতা পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর ও মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির। কারণ দুজনেই স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। রংপুরের মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বা বোঝাপড়া ভালো। মেয়র মোস্তফা বলয়ের লোক হিসেবে দুজনের পরিচিত থাকলেও তারা মূলত এরশাদ বলয়ের লোক বলেই মনে করেন স্থানীয়রা। এরশাদ বলয়ের নেতাকর্মীদের অধিকাংশই নব্য চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের অনুসারী।

এখন জিএম কাদেরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দলের সব মত ও চিন্তাকে সমন্বয় করে রংপুর-৩ আসনের যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া। যেহেতু এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সেহেতু এ আসন হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি দেখছেন জাপা নেতারা। দলের মধ্যকার ঐক্য বিনষ্ট হলে জাপার দুর্গ ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ আসনের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় চেয়ারম্যানকে যেমন দায়িত্বশীল, বিচক্ষণ ও দূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে তেমনি দলের ভেতরকার ঐক্য বজায় রেখে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কতটা যোগ্য ও দূরদর্শী তারও প্রমাণ হবে।

দলের ভেতরকার সক্রিয় কোনো বলয়ই চাইছে না রংপুরের এ দুর্গ জাপার হাতছাড়া হোক। এ জন্য প্রত্যেকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই দলের অভ্যন্তরে আলাপ-আলোচনার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। যে কোনো মূল্যে রংপুরে জাপার ঘাঁটি অক্ষুণœ রাখার কথা বলছেন দলের নেতাকর্মীরা।

রংপুর-৩ আসন জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলেই পরিচিত হয়েছে আশির দশক থেকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে রংপুর-৩ সদর আসনে প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের সিদ্দিক হোসেন।

এরপর ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের কাজী আব্দুল কাদের, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির শফিকুল গাণি স্বপন, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, ১৯৯১, ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ২০০১ সালে জিএম কাদের, ২০০৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ২০০৯ সালের উপনির্বাচনে রওশন এরশাদ, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।

 
Electronic Paper