কোন পথে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি
মনোজ দে
🕐 ১০:২৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৯
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পরও রাজনীতিতে বরাবরই ক্রীড়নক ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিশ্বের আর কোনো সেনাশাসকের দিকে ভাগ্যদেবী বোধহয় এতটা সুপ্রসন্ন ছিলেন না। ৮৯ বছরের দীর্ঘ জীবনের ইতি হয়েছে গত পরশু। সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত শেষে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে জীবনাবসান। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার বাসনায় গড়ে তুলেছিলেন জাতীয় পার্টি। ভাগ্যান্বেষী দলছুট রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা-সেনা কর্মকর্তারা ভিড় জমিয়েছিলেন তার দলে। গত তিন দশকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতার দরবাজিতে প্রভাববিস্তারি ভূমিকা রেখেছে। তাই আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো ক্ষমতা বলয়ের মূলধারার দলগুলোর কাছে বরাবরই কদর ছিল এরশাদ ও জাতীয় পার্টির। কখনো প্রকাশ্যে কখনোবা পর্দার অন্তরালে রাজনীতির ক্রীড়নক ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি কি বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে আগের মতোই গুরুত্ব পালন করতে পারবে?
নিজের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কি হবে এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এরশাদ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে এ নিয়ে তার ভেতরে অস্থিরতাও জন্ম দেয়। বারবার সিদ্ধান্ত পাল্টানও। শেষে ছোটভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং স্ত্রী রওশন এরশাদকে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা করে যান। এ ক্ষেত্রে তার অবস্থান পষ্ট। মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্বে থাকবেন ভাই আর সংসদে এমপিদের নেতৃত্ব দেবেন স্ত্রী। উপমহাদেশের রাজনীতির প্রধানতম ফেনোমেনা পরিবারতন্ত্র। সাবেক সেনাশাসক এরশাদ তার উত্তরসূরিও করে গেছেন নিজের পরিবার থেকেই। এর পেছনে তার উদ্দেশ্য বা চাওয়া বোধহয় একটাই। জাতীয় পার্টির ঐক্য অটুট রাখা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির প্রভাব কতটুকু হবে তা নির্ভর করছে এই ঐক্যের উপরই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এরশাদ জাতীয় পার্টির মহীরুহ বিশেষ। তাকে কেন্দ্র করেই এতদিন টিকে ছিল দলটি। বিতর্কিত হোক বা সমালোচিত হোক শেষ পর্যন্ত নিজ হাতে গড়ে তোলা জাতীয় পার্টির স্বার্থ ছিল তার কাছে সর্বাগ্রে। বলা চলে তিনিই ছিলেন জাতীয় পার্টির সর্বৈসর্বা ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা। ফলে তার সমকক্ষ বা ধারেকাছের নেতা কেউ তৈরি হয়নি দলে। এখন এরশাদের মৃত্যুতে দলের হাল শক্ত করে ধরতে পারবে এমন নেতা কে আছেন?
সাড়ে তিন দশকের পুরনো রাজনৈতিক দল হলেও নিজস্ব আদর্শ জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের মডারেট ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিপরীতে ধর্মকে ব্যবহার করে মর্ডানিস্ট ঘরানার একটা রাজনীতি চর্চা করতে চেয়েছে দলটি। যদিও ‘না ঘরকা না ঘটকা’ আদর্শের এই রাজনীতি চর্চার সুযোগ বেশি হয়নি এরশাদের বরং ক্ষমতার পালাবদলের ‘ঘুঁটি’ হয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। ‘ওয়ানম্যান শো’-নির্ভর জাতীয় পার্টিতে তাই নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। এরপর আবার স্বাধীন সিদ্ধান্ত বাধাও ছিল তার। মেজর জেনারেল মনজুর হত্যা মামলা তাড়িয়ে বেরিয়েছে তাকে। ফলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো দলগুলো বাইরে থেকে জাতীয় পার্টির ভেতরে নিজেদের ‘দুর্গ’ গড়ে তুলতে সফল হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই জাতীয় পার্টিতে দুটি ধারা পষ্ট। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি ধারা, অন্যটি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে। জাপার রাজনীতি ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে তা এই দুই নেতার উপরেই নির্ভর করছে।
নয় বছরের শাসন শেষে জনতার প্রবল গণধিক্কার মাথায় নিয়েই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয় এরশাদকে। এর আগে, রক্তপাতহীন এক সামরিক অভুত্থানে ক্ষমতায় বসেন তিনি। অন্য সেনাশাসকদের মতো দেশ ও গণহত্যা রক্ষার বাহানা দিয়েই ক্ষমতায় বসা। ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার পর ঠাঁই হয় কারাগারে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে কারাগার থেকেই অংশ নিয়ে নিজে পাঁচটি আসনে জেতেন। তার দল পায় ৩৫টি আসন। বলা যেতে পেরে এ এক বিরল ঘটনা। স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন নিয়ে কথা থেকেই যাবে। এক্ষেত্রে মূলধারার দলগুলোর ব্যর্থতা ও আপসের প্রসঙ্গ উঠবে। কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় এরশাদ নিজের এলাকায় মানে উত্তরবঙ্গে ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারেননি তিনি।
এরশাদ ও জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে প্রভাবক ক্রীড়নক হিসেবে আবির্ভূত হয় ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ১৪৬টি আসন পেয়ে জয়ী হলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫০টি আসন পায়নি আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি পায় ১১৬টি আসন। জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি আসন। কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কদর বাড়ে জাতীয় পার্টির। পর্দার অন্তরালে চলতে থাকে নানা সমীকরণ ও দর কষাকষির। বিএনপি চাইছিল রওশন এরশাদকে সামনে নিয়ে একটু ঝুলন্ত সরকার গঠন করার। কিন্তু এরশাদ ছিলেন অনড়। সমর্থন দেন আওয়ামী লীগকে। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রী হন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সাত বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পান এরশাদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেই আবার ১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠন করেন এরশাদ। অবশ্য কয়েক মাসের মাথায় এ জোট থেকে পিছুটানও দেন তিনি। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদে এককভাবেই নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি। তবে এবার মাত্র ১৪টি আসন পায় তারা। দুই বছরের সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গড়ে ক্ষমতার অংশীদার হন এরশাদ। এ সময় জাতীয় পার্টি থেকে কয়েকজন মন্ত্রীও হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অস্থিতিশীল অবস্থায় চলে যায় জাতীয় পার্টি ও এরশাদ। বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলে প্রথমে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন এরশাদ। কিন্তু পরে আবার বেঁকে বসেন। ‘অসুস্থতা’র কারণে সিএমএইচে ভর্তি হন। সরকারের শপথ নেওয়ার দিন হাসপাতাল থেকে বঙ্গভবনে যান। ওই সরকারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন। তার দল সংসদে বিরোধী দল হয়। তবে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে সমালোচিত হয় জাপা।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি দোদুল্যমান ভূমিকায় ফের অবতীর্ণ হয়। দলের একপক্ষ চাইছিল বিএনপি জোটের সঙ্গে যেন নির্বাচনে যায় জাতীয় পার্টি। অন্যপক্ষ আবার চাইছিল স্বতন্ত্র কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই নির্বাচনে আসুক জাপা। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোট করে নির্বাচন করেন এরশাদ। এই নির্বাচনে ২০টি আসন পায় জাতীয় পার্টি।
গত এক বছর ধরেই নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছিলেন এরশাদ। চিকিৎসার জন্য বারবার তাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল। হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন তার সময় শেষ হয়ে আসছে। দলের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে চিন্তিতও হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি দলের উত্তরসূরি নির্বাচন করে গেছেন। তবে দল কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে পষ্ট কোনো দিশা দিয়ে যেতে পারেননি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করলেও কাগজে-কলমে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে জাতীয় পার্টি। এরশাদ মারা যাওয়ার আগে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। যদিও এ সিদ্ধান্তে দলের অনেকেই নাখোশ ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে রয়েছে জাপা। মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন কয়েকজন। ফলে সহজেই তারা এ ক্ষমতাকে ছেড়ে দিয়ে বিরোধী দলের অবস্থানে যেতে রাজি নন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দলটি শেষপর্যন্ত সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে কতটা স্বাধীনভাবে অবস্থান নিতে পারবে তার উপর। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার ঘুঁটি হওয়ার তিন দশকের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দলটিকে। জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ দলকে কতটা একই সুতায় একতাবদ্ধভাবে গাঁথতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছুই।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার পালাবদলের সমীকরণে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি কী ভূমিকা রাখবে এ প্রশ্ন এখন সবার কাছেই। জাতীয় পার্টি কি এখন ভেঙে যাবে, নাকি নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এ জল্পনা চলছে সবখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির শঙ্কা ও সম্ভাবনা দুটিই রয়েছে। কেননা বিগত বছরগুলোতে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমছে। জনভিত্তিও এখন শুধুই উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক। দলটির সবকিছুই আবর্তিত হতো কেন্দ্র করেই। জাতীয় পার্টিতে এরশাদ যেমন শক্তি আবার সীমাবদ্ধতাও তিনি। কেননা স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মনজুর হত্যা মামলাসহ নানা পিছুটান ছিল তার। এখন এখন এরশাদের মৃত্যুতে দলে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই কিন্তু জাতীয় পার্টি যদি বিরোধী দল হিসেবে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে তাদের। আর লেজুড় অবস্থান নিলে আখেরে কয়েকজন নেতা সুবিধা পেলেও শেষে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, নাকি টিকে যাবে- এটা এখনই বলা যাবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ জাতীয় পার্টির দেশি-বিদেশি লবি রয়েছে। এর সঙ্গে ক্ষমতা বলয়ের বিভিন্ন অংশ রয়েছে। জাতীয় পার্টির নিজস্ব সাংগঠনিক টানাপড়েনও রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে নির্ধারিত হবে আগামী দিনের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব রাখতে পারবেন তারা।