ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জেনারেল থেকে রাজনীতিক

হাসান ওয়ালী
🕐 ১০:৫১ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০১৯

প্রায় ৮৯ বছরের জীবনের অধিকাংশ সময়ই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন ক্ষমতার আনুকূল্যে। সামরিক শাসন জারি করে ৯ বছর ক্ষমতা দখলের পর গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও এরশাদ তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন প্রাসঙ্গিক। প্রধান সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করে রাজনীতিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাষ্ট্রপতির আসনে বসে পাকাপোক্ত করেন রাজনীতির ভবিষ্যৎ। সময়ের পরিক্রমায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন তিনি। সবশেষ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার আসন ছিল তার দখলে।

১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে জন্ম নেওয়া এরশাদ ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৪তম ব্রিগেডের মেজর, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়ক এবং সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন এরশাদ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানে কাটান এরশাদ। স্বাধীনতার পর নানা বিতর্কের মধ্যে পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর কর্নেল পদমর্যাদায় অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি। ১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। ওই ঘটনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে এরশাদকে করা হয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান। জিয়া রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করেন। জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় লাইমলাইটে আসা এরশাদ মৃত্যুর আগ অবধি ছিলেন বিএনপির জন্য ‘হুমকি’।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন জিয়া। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং তার নেতৃত্বে বিএনপির সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। প্রথমে বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন এরশাদ। তার এক বছর পর আর রাখঢাক না রেখে আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ। যার এই ক্ষমতারোহণ অবৈধ বলে পরে রায় আসে আদালতের। ক্ষমতা দখলের পর দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তিনি সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন।

এরপরই বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। ১৯৮২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়। সে বছরই নভেম্বরে তৈরি হয়েছিল সব ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ফোরাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আন্দোলনের তোপে নিজে রাজনীতিক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তৎপর হন এরশাদ। ১৯৮৬ সালের শুরুতে বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ এবং মওদুদ আহমেদসহ অনেক রাজনীতিককে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রপতি হন। জেনারেল এরশাদের ১৯৮৬ সালের সংসদ টিকেছিল মাত্র এক বছর। ১৯৮৮ সালে তিনি মূল ধারার দলগুলোর বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচন করলেও তিনি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। দুই বছর পরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বামপন্থী দলগুলোর গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের শাসনের পতন হয়।

পতনেও থেমে থাকেননি এরশাদ। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসার পর তিনি জেলে থেকেই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার দল জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। এরশাদ জেনারেলের তকমা ছেড়ে রাজনীতিক হওয়ার পথে এগোতে থাকেন। এরপরের সংসদ নির্বাচনগুলোতে তিনি নিজে কখনো পরাজিত হননি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি জেলে থেকেই আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য সমর্থন দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছয় বছর জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান জেনারেল এরশাদ।

১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি অবস্থান তৈরি করে নেয়। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের ১৭টি আসনে জাতীয় পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করায় নির্বাচন এলেই প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তাকে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে গত কয়েক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই গাঁটছাড়া ছিল এরশাদের দলের। গত দশম সংসদে তার দলের তিনজন নেতা সরকারের মন্ত্রিসভায় ছিলেন এবং তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ছিলেন। একই সঙ্গে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ ছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হিসেবে অংশ নিয়ে ২২টি আসন পায়। এরপর জীবন সায়াহ্নে এসেও এক সময়ের প্রতাপশালী শাসক জেনারেল এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন।

 

 

 
Electronic Paper