জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যে এরশাদ
মনোজ দে
🕐 ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০১৯
সেনা ছাউনি থেকে রাষ্ট্রপ্রধান। ছাত্রজনতার ওপর দমনপীড়নে স্বৈরাচার তকমা। জয়নাল, দীপালি, কাঞ্চন, রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হাত। শেষে ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিকদের গণঅভ্যুত্থানে পতন। জেলে বসেই নির্বাচন ও জনতার ভোটে সংসদ সদস্য। রাজনীতিতে পুনর্বাসন ও ক্ষমতার দরকষাকষিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে ওঠা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনপ্রেডিকটেবল এবং নন্দিত-নিন্দিত ব্যক্তিত্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কেমন ছিল সাবেক এই জেনারেলের জীবন? মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) তাদের দুটি বইয়ে জানিয়েছেন এরশাদের জীবনের কিছু অধ্যায়।
কর্নেল শাফায়াত জামিল ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় এরশাদের ভূমিকা নিয়ে জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এরশাদ সম্পর্কে বলার আরও কিছু রয়েছে। অভিযোগ শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন এবং যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সুযোগ সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে যান। এ কারণে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন, সে অনুযায়ী তার চাকরিচ্যুত হওয়ার কথা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে এই নীতিমালা অনুযায়ী অব্যাহতি দেওয়া হয়। জনা পঞ্চাশেক অফিসারকে এ জন্য চাকরি হারাতে হয়। কিন্তু একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও এরশাদ চাকরিচ্যুত তো হনই নি, বরং প্রমোশনসহ এজি (অ্যাডজুজেন্ট জেনারেল) পদে অধিষ্ঠিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর পর পাকিস্তান থেকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশে ফেরেন। আটেকপড়া সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সে সময় পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে ছিলেন বন্দি। কিন্তু এর মধ্যেই এরশাদ চারবার বিমানযোগে বাংলাদেশে আসেন বলে সে সময়কার রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিল তার বইয়ে জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমার ধারণা, এরশাদ ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর আশীর্বাদপুষ্টদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি অন্তত চারবার বিমানযোগে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী (?) পাকিস্তান থেকে রংপুরে তার বাড়িতে পাঠান। আটকে পড়া বাঙালি সামরিক অফিসাররা তখন তো বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নানারকম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো নিয়মিত বিমান চলাচলও ছিল না। অনিয়মিতভাবে চলাচলকারী আইসিআরসি (আন্তর্জাতিক রেডক্রস)-এর ভাড়া করা প্লেনে এরশাদ সাহেবের সেসব জিনিসপত্র পাচার করার অপারেশন করা হয়। শাফায়াত জামিলের মতে, আটকেপড়া প্রায় বারোশ অফিসারের আর কারোরই তার মতো সুযোগ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ১৯৭৪ সালে মেজর ডালিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের ঘটনায় তৎকালীন কর্নেল এরশাদ ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতলব আঁটেন’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে এরশাদের উচ্চাভিলাষী মানসিকতা এবং সেনাবাহিনীতে কীভাবে দ্রুত ক্রমোন্নতি করেন তা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৩ বছর চাকরির পর ১৯৬৫ সালে এরশাদ মেজর পদে উন্নীত হন। একজন দক্ষ, চৌকস ও বিচক্ষণ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে যদিও তার সুনাম ছিল না, কিন্তু চতুর সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার প্রচুর দক্ষতা ছিল।’ যেমন তিনি জেনারেল ওসমানীর প্রিয় পাত্র হতে পেরেছিলেন। পকিস্তান-প্রত্যাগত এরশাদ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। এরপর মাত্র সাত বছরে তিনি লে. কর্নেল থেকে তরতর করে লে. জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে যান। আর আট বছরের মাথায় তিনি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে যান।
মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনৈক্যের একটি প্রধান কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সেনা-অফিসারদের দ্বন্দ্ব। এরশাদ উপসেনাপ্রধান হওয়ায় এ সুযোগকে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কাজে লাগান। তিনি এদের মধ্যে বিভেদের ফাটল সৃষ্টি করেন। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের দাবিয়ে রেখে অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধার পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেন।
জিয়াউর রহমানকে রাজনীতিতে জড়ানোর জন্য এরশাদ উৎসাহিত করতেন বলে মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য। তিনি লিখেছেন, উপ-সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এরশাদ জিয়াকে রাজনীতিতে জড়ানোর জন্য উৎসাহিত করতেন। এর সঙ্গে লুকিয়ে ছিল এরশাদের নিজের স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের উচ্চাভিলাষী আকাক্সক্ষা।
জেনারেল মইনুল মনে করেন, ছলনা ও চাতুর্য দিয়ে এরশাদ জিয়ার আস্থাভাজন হন। নৈতিক চরিত্র নিয়ে কানাঘুষা ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও ১৯৭৯ সালের ২৯ এপ্রিল এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হয়। সেনাপ্রধান হওয়ার পর এরশাদ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য ও প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি করেন। কৌশলে স্পর্শকাতর পদগুলো থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরপরই এরশাদ ক্ষমতায় বসার পরিকল্পনা করেন বলে মনে করেন জেনারেল মইনুল। জেনারেল মঞ্জুরের হত্যা পরিকল্পিত ছিল বলেই মত তার। তিনি লিখেছেন, মূলত মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাষী, ষড়যন্ত্রকারী ও কিছু অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে। এটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফল।