ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কী প্রকল্প অলির?

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৬, ২০১৯

লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ নামে নতুন যে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করেছেন তাতে জায়গা পেতে যাচ্ছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামী। গত ২৭ জুন এ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অলি আহমদ জামায়াতকে তার জোটে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের জামায়াত আর ২০১৯ সালের জামায়াত এক নয়। এরা হলো বাংলাদেশের জামায়াত, এই দেশকে তারা ভালোবাসে। তাদের মধ্যে অনেক সংশোধনী আসছে এবং তারা নিজেদের মধ্যেও বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তারা দেশপ্রেমিক শক্তি।’

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধা অলি আহমদ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই যুক্ত ছিলেন বিএনপিতে। পরে মতদ্বৈততার কারণে বিএনপি ছেড়ে গিয়ে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল এলডিপি। বিএনপিতে থাকাকালীন দলের অভ্যন্তরে জামায়াতের কট্টর সমালোচক ছিলেন কর্নেল অলি। বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের সঙ্গে দলের গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। শুধু দলেই নয় চট্টগ্রামের নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও অলি আহমদকে সবসময় লড়তে হয়েছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। ফলে অলি আহমদ থাকাকালে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য বা জোট গড়ার ক্ষেত্রে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি জামায়াত। যদিও পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত ও অলিকে এক সঙ্গেই থাকতে হয়েছে।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বা সী অন্য অনেকের মতো অলি আহমদও জামায়াত প্রশ্নের শেষ কথা রাখার পক্ষে ছিলেন। সেই অলি আহমদ একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে জামায়াতের মতো দলের সাফাই গাইবেন এবং তাদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করবেন-এমনটা কেউ ভাবতেই পারেননি। ফলে ২৭ জুনের সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন কর্নেল অলি।

রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, জামায়াত অত্যন্ত ধুরন্ধর একটি দল। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করে, গণহত্যায় মদত জুগিয়েও দলটি স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেছে। ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে একাধিকবার। যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার কৌশল জানা আছে দলটির। স্বাধীনতার পর থেকে নানা কৌশলে তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে বিএনপির কাঁধে ভর করে শক্ত-সামর্থ্য ভিত তৈরি করেছে রাজনীতিতে। দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদী কর্মকা-, রাজনীতিতে সন্ত্রাস-সহিংসতার বিস্তার ঘটিয়ে জামায়াত ধীরে ধীরে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠে। মূলত স্বাধীনতার পর থেকে দলটির পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সামরিক- স্বৈরাচারী শাসকরা এবং বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

গত এক দশকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০ দলের শরিক জামায়াতও এ সময়ে চরম সংকটের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে একাধিক শীর্ষনেতার মৃত্যুদ-ের রায় কার্যকর এবং দলীয়ভাবে যুদ্ধপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ উঠে আসার কারণে রাজনীতিতে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়া এবং দলটিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আদালতে মামলা চলমান থাকায় রীতিমতো অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে দলটি। এ অবস্থায় দিশেহারা জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নানা চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা চাইছে নামে-বেনামে যে কোনো কৌশলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তারই অংশ হিসেবে দলটি এখন বিএনপিকে ছেড়ে এলডিপির অলি আহমদের ওপর সওয়ার হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অলি আহমদ যে দিন সংবাদ সম্মেলন করেন সেদিন জাতীয় মুক্তিমঞ্চের শরিক হিসেবে তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আরেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ইব্রাহীম বীরপ্রতীক। সামনে উপবিষ্ট ছিলেন জামায়াতের কর্মীরা। ওই ঘটনার পর শুধু অলি আহমদ নয়, একইভাবে সমালোচনার মুখে পড়েন ইব্রাহীম বীরপ্রতীকও।

ভাষ্যকারদের মতে, জামায়াতের পুনর্জাগরণের নতুন প্রকল্প নিয়েছেন কর্নেল অলি ও মেজর ইব্রাহীম। এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে জামায়াত। এর আগে গত বছর জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। একই সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন দলের মজলিসে শুরার সদস্য, সাবেক শিবির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু। গত এপ্রিলে মঞ্জুর নেতৃত্বে জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক শিবির কর্মীদের নিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যেই এই কথা চাউর হয়েছে যে, মঞ্জুর নেতৃত্বে চলমান রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াটি মূলত জামায়াতের আরেকটি কৌশল। জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে প্রকাশ্যে এমন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম করতে চায় যাদের দেখে অবস্থাদৃশ্যে মনে হতে পারে তারা জামায়াতের সমালোচক বা জামায়াতবিরোধী। মূলত তারা মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে তার সুযোগ নিতে চায়।

বিষয়টি রাজনৈতিক ময়দানে অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে যাওয়ায় জামায়াত ফের কৌশল পাল্টে সওয়ার হয়েছেন কর্নেল অলি ও মেজর ইব্রাহীমের কাঁধে। মুক্তিযুদ্ধের দুই বীরযোদ্ধার মাধ্যমে জামায়াত এই স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে, যে এই জামায়াত একাত্তরের জামায়াত নয়। এটা নতুন জামায়াত। যদিও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার সম্প্রতি এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, তিনি (অলি আহমদ) বলেছেন, ‘একাত্তরের জামায়াত আর এখনকার জামায়াত এক নয়।’ বিষয়টিকে একটু বদলে কেউ যদি বলেন, ‘একাত্তরের অলি আর এখনকার অলি এক নয়।’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য অলি আহমদ যুদ্ধ করেছেন, আর জামায়াত করেছে বিরোধিতা। সেই জামায়াতের বন্দনা যখন অলির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, তখন জামায়াত হয়তো হাসে, কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়।’

 
Electronic Paper