ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সংরক্ষিত আসনে রুমিন ফারহানা

বিএনপিতে পক্ষ-বিপক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০০ অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০১৯

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে দলের সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছেন বিএনপির শীর্ষনেতারা। সেই বিভক্তি প্রভাব ফেলছে দলে। যদিও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশীর্বাদধন্য হওয়ায় রুমিনের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুলছেন না কেউ।

নানা নাটকীয়তার পর গত এপ্রিলের শেষদিকে বিএনপির সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সাম্প্রতিক রাজনীতিতে চমক সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর পাশাপাশি আরও দুটি ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন রাজনৈতিক মহল। তার মধ্যে একটি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথ না নেওয়া এবং অপরটি হলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও হেভিওয়েট প্রার্থীকে বাদ দিয়ে সংরক্ষিত আসনে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও তরুণ নেতা রুমিন ফারহানাকে মনোনয়ন দেওয়া। একাদশ জাতীয় সংসদে মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি এককভাবে পায় ছয়টি আসন। এর বিপরীতে সংরক্ষিত আসনের কোটায় বিএনপি পায় একটি আসন। সে আসনের জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে উঠে এসেছিল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী, জেবা খান, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস, সাবেক এমপি সৈয়দা আশরাফী পাপিয়া ও সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার নাম।

এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথির মধ্য থেকে কেউ একজন এই সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হোক এমনটা চাইছিলেন দলের কেউ কেউ। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে জিয়া পরিবারের কাউকে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দলের হাইকমান্ড। ফলে তার বাইরে মনোনয়ন প্রত্যাশী বা প্রস্তাবিত নামগুলো থেকেই মনোনয়নের জন্য নাম বাছাই করা হয়।

প্রথম দফায় চারজনের নাম প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেন শীর্ষনেতারা। তারা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায়ের মেয়ে নিপুণ রায়, দলের প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ এবং সাম্প্রতিক সময়ে টকশোর আলোচিত মুখ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তাদের মধ্যে তারেক রহমানের পছন্দের শীর্ষে ছিলেন রুমিন। দলে খুব পরিচিত মুখ না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দলের পক্ষে বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং টিভি টকশোতে যুক্তিনির্ভর বক্তব্য উপস্থাপন এবং বাগ্মিতা প্রদর্শন করে দলের অনেক শীর্ষনেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। তা ছাড়া ব্যারিস্টার হওয়ায় আইনি বিষয়ে পারদর্শিতা রয়েছে তার। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন অসংখ্যবার। তা ছাড়া দলের কূটনৈতিক উইংয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে রুমিনের।

এ সময়ের টক শোর জনপ্রিয় মুখ, বয়সে তরুণ, মেধাবী, কৌশলী এবং বাগ্মী হওয়ায় রুমিনকেই সংসদের সংরক্ষিত আসনের জন্য বেছে নেন তারেক রহমান। এতে নাখোশ হন দলের প্রবীণ নেতা মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমানসহ অনেকে।

দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দলের একটি পক্ষ চেয়েছিলেন আফরোজা আব্বাস পাক সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন। কারণ পারিবারিক ঐতিহ্য ও রাজপথে নানা সময়ে ভূমিকা রাখার কারণে মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের জনপ্রিয়তা রয়েছে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে। বিশেষ করে গত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মির্জা আব্বাসের প্রচারাভিযানে ভূমিকা রেখে তিনি আস্থাভাজন হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। আফরোজা আব্বাস ঢাকা-৮ আসন থেকে গত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তার জন্য লন্ডনে লবিং করেছেন মির্জা আব্বাসসহ অনেক নেতা।

অন্য আরেকটি পক্ষ চেয়েছিল, রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠনে পটু, লড়াকু নেত্রী হিসেবে পরিচিত নিপুণ রায় চৌধুরীই আসুক সংসদে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ স্থায়ী কমিটির একটি অংশ নিপুণের পক্ষে দেনদরবার করেছেন তারেক রহমানের সঙ্গে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে পেছনে ফেলে সিঁকে ছেঁড়ে রুমিন ফারহানার।

কয়েকটি সূত্র জানায়, রুমিনের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে না পারলেও স্থায়ী কমিটির যারা তারেক রহমানের হয়ে রুমিনের পক্ষাবলম্বন করেছেন তাদের ওপর আকারে ইঙ্গিতে ক্ষোভ ঝাড়ছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাসসহ অনেকে। অন্যদিকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল রয়েছেন একেবারে নিরাপদ অবস্থানে। এ ব্যাপারে তিনি প্রথম থেকেই ছিলেন নিষ্পৃহ। কারণ দল সংসদে যাক সেটাই তিনি চাননি। তার মধ্যে সংরক্ষিত আসনে দলের মনোনয়ন নিয়ে তিনি খুব একটা ‘সিরিয়াস’ ছিলেন না। যদিও বিএনপি সংসদে যাওয়ার পর থেকে অনেকেই লন্ডনে গোপন লবিং শুরু করেছিলেন।

সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনীত হওয়ার পর রুমিন ফারহানাকে নিয়ে অনেকের কৌতূহল বেড়ে যায়। জানতে চান কে এই রুমিন। তারেক রহমানই বা কেন রুমিনকে এতটা গুরুত্ব দিলেন?

ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম রুমিন ফারহানার। বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ভাষাসৈনিক প্রয়াত অলি আহাদের একমাত্র সন্তান তিনি। ড্যামোক্র্যাটিক লীগ নামে বাবা অলি আহাদের প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল থাকার পরও তিনি কখনো সে দলে যুক্ত হননি। সক্রিয় হয়েছেন বিএনপির রাজনীতিতে। তিনি দলের সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।

হলিক্রস স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং যুক্তরাজ্যের লিংকনস্? ইন থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। টিভি টকশোর প্রিয় মুখ রুমিন মূলত আলোচনায় আসেন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে। সরকারের সমালোচনা করে এবং বিএনপির পক্ষে জ্বালাময়ী কথা বলে দেওয়া বক্তব্য বা টকশোর আলোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তিনি। দলের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে তিনি দলের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। সে আসন থেকে নির্বাচন করে জিতে আসেন বিএনপির প্রবীণ রাজনীতিক উকিল আবদুস সাত্তার।

আমি দাঁড়ালেই সবাই উত্তেজিত হন
বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, ‘আমি সংসদে কথা বলার জন্য দাঁড়ালেই সরকারদলীয় তিনশ এমপি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। আমি আমার দলের কথা বলব, তারা তাদের কথা বলবেন। কিন্তু আমি উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো সংসদ যদি উত্তেজিত হয়ে যায়, ৩০০ সদস্য যদি মারমুখী হয়ে যান তাহলে আমি আমার বক্তব্য কীভাবে রাখব?’

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় সংসদের সভাপতিত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আমি আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব, আপনি এমন কোনো কথা বলবেন না যেটাতে অপর পক্ষ উত্তেজিত হবে এবং সংসদ পরিচালনায় ব্যত্যয় ঘটবে।’

এরপর রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমরা সংসদে আসার সময় সংসদ নেতা বলেছিলেন, আমরা আমাদের কথা বলতে পারব। সংসদ সদস্যরা ধৈর্যসহকারে সেটি শুনবেন। আমার প্রথম দিনের দুই মিনিটের বক্তব্য এক মিনিটও শান্তিতে বলতে পারিনি। একই ঘটনা আজকেও ঘটছে। যদি তাই হয় তাহলে কোন গণতন্ত্রের কথা আমরা বলি, কোন বাকস্বাধীনতার কথা বলি, কোন সংসদের কথা আমরা বলি? এভাবে তো একটা সংসদ চলতে পারে না।’

সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একটা সরকারের সক্ষমতা ক্রমশ বাড়ার কথা। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি এ সরকারের সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বাজেটের মাত্র ৭৬ শতাংশ আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। যে রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সেই রাজস্ব আমরা কখনই আদায় করতে পারি না।

 
Electronic Paper