ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জাপা কি আঞ্চলিক দল?

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৩১ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৮

জোট-ভোটের রাজনীতিতে ‘ফ্যাক্টর’ হলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) ধীরে ধীরে আঞ্চলিক দলে পরিণত হচ্ছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ও অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতার সমীকরণ জাপা সম্পর্কে এমন আশঙ্কাই প্রকট করে তুলেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অচিরেই জাতীয় পার্টি রংপুরে বন্দি হয়ে পড়বে।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপা প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সামর্থ্য না থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দলটি সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন হাজির করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদ রংপুরের সন্তান হওয়ায় তার ব্যাপারে বিশেষ আবেগ কাজ করে রংপুরবাসীর। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাছাড়া হওয়ার পর ১৯৯১-এর পুরো বিএনপি আমল কারাগারে কাটাতে হয় এরশাদকে। কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি ১৯৯৬-এর ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুরের ৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ‘রংপুরের ছাওয়াল’ হিসেবে এরশাদ বিশেষ কদর ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে। সে কারণে জাপা ও এরশাদ রংপুরবাসীর কাছে সমার্থক। শুরু থেকেই এ অঞ্চলে জাপার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে জাপা যত আসন পায় তার অধিকাংশই রংপুর ও তার আশপাশের অঞ্চলের। রংপুরকে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলেও অনেকে মনে করেন। শুধু সাধারণ ভোটাররাই নন, দলটির শীর্ষ নেতারাও মনে করেন রংপুর তাদের ঘাঁটি। বিভিন্ন সময় এরশাদ নিজের মুখেও সেই কথা বলেছেন। জাতীয় রাজনীতি থেকে মুখ থুবড়ে পড়লেও নিজ অঞ্চল রংপুরে এরশাদ জীবদ্দশায় ঠিকই কয়েকটি আসন ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা এবং রংপুরের শক্তি নিয়েই জাপা শেষতক জাতীয়ভিত্তিক যে কোনো রাজনৈতিক জোটে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে থাকবে। দলটি বর্তমান সংসদে প্রধান বিরোধী দল এবং সরকারের অংশীদারও। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে তারা ন্যূনপক্ষে ৭০টি আসন এবং ১২টি মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও খুলনা সিটি নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর জাপার এ ‘আব্দারের’ ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃহত্তর রংপুর ও সিলেটের কিছু অংশ ছাড়া সারা দেশে জাতীয় পার্টির কোনো প্রভাব নেই। জাপা যে একটি আঞ্চলিক দল খুলনা সিটি নির্বাচনের পর তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতেও জাপা ধীরে ধীরে কোণঠাসা হবে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতিতে দরকষাকষির প্রশ্নে জাপা অনেকটাই ধরাশায়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনদের কাছে।
নিজেদের দুর্গখ্যাত রংপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুকে হারিয়ে। বিভিন্ন মহলে চাউর আছে- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এরশাদকে কৌশলে ছাড় দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশীদার হিসেবে এখানে জাপা প্রার্থী আওয়ামী লীগের ‘আশীর্বাদ’ পেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিও এরশাদকে তেমন একটা ‘উত্ত্যক্ত’ করেনি, কারণ ভোট-জোটের সমীকরণে নিজেদের এরশাদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করেছেন তারা।
এর আগে ২০১৫-এর এপ্রিলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত সাঈদ খোকন ও আনিসুল হক, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আ জ ম নাসির এবং ২০১৬-এর ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী জয়লাভ করেন। কথিত আছে নারায়ণগঞ্জ সিটিতে প্রার্থী দেওয়ার মতো বাস্তবতা ছিল না জাপার। একইভাবে ডিসিসির দুই অংশ এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেও জাপার শক্তিশালী প্রার্থী ছিল না যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ অবস্থান তৈরি করবেন। তিন সিটি নির্বাচনেই জামানত হারান জাপা প্রার্থীরা। ডিসিসি দক্ষিণে মেয়র পদে সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন পেয়েছিলেন ৪৫১৯ ভোট, ডিসিসি উত্তরে বাহাউদ্দিন বাবুল পেয়েছিলেন ২৯৫০ ভোট এবং চট্টগ্রামে সোলেমান শেঠ পেয়েছিলেন ৬১৩১ ভোট। যেখানে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগে বিজয়ী প্রার্থী আ জ ম নাছির পান ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট, ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক পান ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট এবং দক্ষিণে সাঈদ খোকন পান ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। সর্বশেষ খুলনা সিটি করপোরেশনে বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেকের ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫১ ভোটের বিপরীতে জাপা প্রার্থী এস এস শফিকুর রহমান পান মাত্র ১ হাজার ৭২ ভোট।
জাতীয় নির্বাচনের পরিসংখ্যান দেখা যায়, জোটবদ্ধ হওয়া ছাড়া এককভাবে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক জোটগুলোতে দলটি বরাবরই ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে থেকেছে। কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে আবার কখনো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে তারা। ১৯৯০-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে টানা ৯ বছরের শাসনক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর ১৯৯১ এর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। সেবার বিএনপি ১৪০ আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সরকার গঠন করে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে। ১৯৯৬-এর ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন কমে হয়েছিল ৩২। সেবার আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ২০০১ এর সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীসহ জাতীয় পার্টি আসন পায় মাত্র ১৪টি। সে নির্বাচনের আগে দলটি ভেঙে তিন ভাগ হয়ে যায়। নাজিউর রহমান মঞ্জুর এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু’র নেতৃত্বে যথাক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও জাতীয় পার্টি (জেপি) গড়ে ওঠে। তারা পান ৫টি আসন। ওই নির্বাচনে জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে ‘চারদলীয় ঐক্যজোট’ গঠন করে নির্বাচনী জোট করেছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে পায় ১৯৩ আসন। ২০০৮-এর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোট করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এককভাবে ২৩০ আসন নিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পায় ২৭টি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি এককভাবে বরাবরই কম আসন পেয়েছে। কিন্তু ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে জোটভুক্ত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন সবসময় ২০-এর ওপরে থেকেছে। তবে দিন দিন দলটির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যে হারে কমতে শুরু করেছে তাতে শিগগিরই দলটি রংপুরভিত্তিক আঞ্চলিক দলে পরিণত হবে।
বাংলাদেশে আঞ্চলিক দল হিসেবে তিন পার্বত্য জেলার কয়েকটি দল, বিশেষ করে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ এবং এর খণ্ডিত অংশগুলোই উল্লেখযোগ্য। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনো অংশগ্রহণ না থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলের নানা ইস্যুতে কখনো কখনো সরব থাকতে হয় জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে। বস্তুত বিদ্যমান আঞ্চলিক দলগুলো দেশের জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম নয়। তবে পার্শ্ববর্তী ভারতে অঞ্চলভিত্তিক নানা দলের ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। ভারতে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা জোটে প্রদেশকেন্দ্রিক দলগুলো সরকার গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী দল, বহুজন সমাজ পার্টি, পাঞ্জাবে আকালি দল, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, কর্নাটকের জনতা দল, বিহারের জনতা দল ইউনাইটেড উল্লেখযোগ্য।

 
Electronic Paper