ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুক্ত পরিবেশে খালেদার চিকিৎসায় জোর বিএনপির

প্যারোল নিয়ে লুকোচুরি

রহমান মুফিজ
🕐 ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০১৯

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে লুকোচুরি। দলটির ৬ এমপির সংসদে যোগদানের শর্তে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা চলছে-এ রকম জোর গুঞ্জনের মধ্যেই শীর্ষনেতারা বলছেন, বিএনপি সংসদেও যাবে না, খালেদা জিয়া প্যারোলও নেবেন না। তবে একই সঙ্গে দলীয় চেয়ারপারসনের এ মুহূর্তে ‘মুক্তি ও সুচিকিৎসা’রও বিকল্প দেখছেন না তারা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার জামিনে সরকারের হস্তক্ষেপ নেই। গতকালও তারা বলেছেন, যদি খালেদা জিয়া প্যারোলের আবেদন করেন তবে ভেবে দেখা হবে।

যদিও কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষনেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, প্যারোলের বিষয়টি একান্তই খালেদা জিয়া বা তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপার। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে দল থেকে প্যারোল নয়, খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে।

চলতি মাসের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরেফিরে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির গুঞ্জন।

এ গুঞ্জনের নেপথ্যে রয়েছে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেওয়ার ডেড লাইন ‘৩০ এপ্রিল’। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচিত ৬ এমপি সংসদে যাবে না বলে দল থেকে জানানো হলেও সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির নানা সমীকরণ পাল্টে যেতে থাকে। অসুস্থ খালেদা জিয়াকে মুক্ত পরিবেশে চিকিৎসার বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। সেই সূত্র ধরে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসে ৬ এমপির সংসদে যোগদানের শর্তে সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক রাজনৈতিক সমঝোতায় যেতে চায় বিএনপি। সে ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানোর বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। কারান্তরীণ খালেদা জিয়া অসুস্থাবস্থায় গত ১ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দলীয় চেয়ারপারসনের দ্রুত কারামুক্তি ও তার সুচিকিৎসার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপি শেষ মুহূর্তের দর-কষাকষি চালাচ্ছে বলে জানায় বিভিন্ন সূত্র। তবে প্রকাশ্যে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, কোনো শর্তেই বিএনপি সংসদে যাবে না। খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে তারা সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করবে না। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিএনপির নির্বাচিত ৬ সংসদ সদস্যের শপথ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটা দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত। তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না। একই অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান খালেদা জিয়াকে মুক্ত পরিবেশে এনে সুচিকিৎসার দাবি জানান।

এর আগে, বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্যারোলের নামে সরকার ‘অশুভ চক্রান্ত’ করছে বলে অভিযোগ করেন। প্যারোলের খবরকে সরকারপন্থি মিডিয়ার প্রপাগান্ডা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার ফর্মুলা হিসেবেই প্যারোলের খবর রটানো হচ্ছে। এর পেছনে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে মন্তব্য করে বলেন, প্যারোল নিয়ে সরগরম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সরকার খালেদা জিয়ার জীবন হুমকির মুখে ফেলে সুদূরপ্রসারী স্বার্থসিদ্ধির ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বিএনপি নেতৃবৃন্দের এসব বক্তব্যের জবাবে সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গতকাল শিল্পকলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার এমন কোনো বেকায়দায় পড়েনি যে, আদালতে দণ্ডিত খালেদা জিয়াকে যেকোনো উপায়ে মুক্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন। আদালতে জামিন পাওয়াই তার মুক্তির পথ। আর প্যারোল নিতে হলে খালেদা জিয়াকেই তা চাইতে হবে। তিনি চাইলেই তা বিবেচনার সুযোগ থাকে। কাউকে তো জোর করে প্যারোল দেওয়া যায় না। এদিকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, খালেদা জিয়ার জামিনে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন।

বিএনপির একটি সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার প্যারোল পেতে কোনো শর্তে রাজি হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেটা তিনি আবেদন করলেই পাবেন। সে ক্ষেত্রে খালেদার প্যারোলের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেওয়া না নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি সিদ্ধান্তই নিয়েছে তারা সংসদে যাবে না। আর প্যারোলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন খালেদা জিয়া বা তার পরিবারের লোকজন। প্যারোল এবং শপথ দুটো আলাদা বিষয়। খালেদার নিঃশর্ত মুক্তির ব্যাপারে যদি সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতার প্রশ্ন উঠত তাহলে বিষয়টা ভেবে দেখা যেত।

দুর্নীতি মামলায় দণ্ড নিয়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আন্দোলন ও আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে তার মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হয় বিএনপি। বিএনপির বিভিন্ন সূত্র এ খবর গণমাধ্যমে জানিয়েছে। গত ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে সাংবাদিকদের সামনে খালেদা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন বলে বক্তব্য দেন খালেদার আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছিলেন, দণ্ডিত হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং খালেদা জিয়াকেও তা চাইতে হবে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়া প্যারোলের আবেদন করলে তা সরকার খতিয়ে দেখবে।

এরপর থেকে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে খালেদার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি। সরকারের উঁচু মহলের সঙ্গে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে দফায় দফায় আলাপও হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপিকে বারবার ভাবতে হচ্ছে-দলীয় চেয়ারপারসনের প্যারোলে মুক্তি দলের মধ্যে এবং রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এ নিয়ে দলের মধ্যেই রয়েছে দ্বিধা-বিভক্তি। তাই তারা আরও কয়েকটি দিন সময় নিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে চান। তবে সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তা আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই নিতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, দলের একপক্ষ মনে করছেন, যত দ্রুত সম্ভব সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি জরুরি। কেননা, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা নাজুক। তার সুচিকিৎসা দরকার। প্যারোল বা জামিন যে উপায়েই হোক তাকে মুক্ত পরিবেশে রাখা দরকার। অপর পক্ষ মনে করে এ মুহূর্তে প্যারোলে মুক্তি নিলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দলে। খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে যে ইমেজ আছে তা নষ্ট হবে এবং তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিপর্যয় ঘটবে। সরকারও তার প্যারোল নেওয়াটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে অপপ্রচার চালাবে। তাই আইনিভাবেই তার জামিন হওয়া দরকার। তাদের মতে সরকার আদালতে হস্তক্ষেপ না করলে খালেদা জিয়া এমনিতেই জামিন পাবেন।

বিএনপির নীতি-নির্ধারণী একটি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তারা যেমন উদ্বিগ্ন, তার পরিবারের সদস্যরাও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। পরিবারের সদস্যরাই চান বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসা যেন হয়। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি বা জামিনের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকেই আবেদন করতে হবে। তবে এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়ারই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের মধ্যকার বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিকল্প দেখছে না বিএনপির বেশির ভাগ নেতা। তবে সিদ্ধান্তের জন্য ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় দলটির নীতি-নির্ধারকরা।

 
Electronic Paper