ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিএনপির সতর্ক পর্যবেক্ষণ

খালেদার প্যারোলে মুক্তি প্রসঙ্গ

কুন্তল দে
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০১৯

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘মুক্তি’ নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সতর্ক পর্যবেক্ষণ করতে চায় বিএনপি। সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো হতে পারে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দ্রুত কারামুক্তি ও তার সুচিকিৎসার বিষয়টি বর্তমানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তবে তার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসা কোন পথে হবে তা নিয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দোটানাও রয়েছে দলের নেতৃত্বে।

সরকারের উঁচু মহলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে দফায় দফায় আলাপও হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরও সময় নিতে চায় ১২ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৩০ এপ্রিলের ডেডলাইন রয়েছে। কেননা সংবিধান অনুযায়ী বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার জন্য সময়সীমা শেষ হচ্ছে ওইদিন। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও লন্ডনে চিকিৎসার ব্যাপারটি ইতিবাচকভাবেই তারা দেখছেন। তবে এজন্য বেশ বড় শর্ত তারা দিয়েছেন বিএনপির সামনে। সরকার চাইছে বিএনপি থেকে নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিক। সংসদে এসে তাদের বক্তব্য তুলে ধরুক।

দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও প্যারোলে (নির্বাহী আদেশে) মুক্তি হলে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তা কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে দলের নেতৃত্বে। একপক্ষ মনে করছেন, যত দ্রুত সম্ভব সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি জরুরি। কেননা, বিএনপির চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তার সুচিকিৎসা প্রয়োজন। প্যারোলে হোক, জামিনে হোক; দেশে হোক, বিদেশে হোক তার কারাগারের বাইরে থাকা প্রয়োজন। কেননা বিএনপিতে খালেদা জিয়ার বিকল্প এখনো কেউ নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের যে দৈন্যদশা তা থেকে উত্তরণের জন্য খালেদা জিয়ার পরামর্শও জরুরি। জেলের ভেতর থেকে এ বিষয়ে কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

বিএনপির এই পক্ষ মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির মাধ্যমে যদি তাদের নির্বাচিত ছয়জন এমপির শপথ নেওয়ার দরকার হয় তা নিতেও তারা রাজি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে আটজন নির্বাচিত হন। এরই মধ্যে গণফোরামের দুজন সংসদ সদস্য সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান শপথ নিয়েছেন। বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (বগুড়া-৬) এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মো. হারুন অর রশীদ ছাড়া অন্য চারজন জাতীয় রাজনীতিতে কোনো পরিচিত মুখ নন। গত সোমবার মির্জা ফখরুলসহ ছয় জন রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বৈঠকও করেছেন। শপথ নিয়ে করণীয় কী সে বিষয়ে দলের মনোভাব জানতেই এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত অন্য চার জন হলেন, বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত মো. আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচিত উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া।

বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের আরেকটি পক্ষ মনে করছেন রাজপথ ও আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তিটাই হবে বিএনপির জন্য যথার্থ। এ পক্ষের নেতারা তার সুচিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিলেও ‘প্যারোলে মুক্তি’র বিষয়টিকে অসম্মানজনক বলে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করছেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে এটা সরকারের আরেকটি চাল। প্যারোলে মুক্ত হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার যে আপসহীন ভাবমূর্তি সেটা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোলে গেলে উনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এখানেই সমাপ্তি ঘটবে। আর বিএনপি সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বহীন হয়ে যাবে। কারণ খালেদা জিয়াই তো বিএনপির জন্য ঐক্যের প্রতীক।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা অবশ্য এ চিন্তায় ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের প্যারোলে মুক্তি এবং পরবর্তীতে সম্মানের সঙ্গে দল ও দেশ পরিচালনার নজির রয়েছে বলে বলেন তিনি। এক-এগারোর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্যারোলে মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন তিনি। ১১ মাস কারান্তরীণ থাকার পর ২০০৮ সালের জুন মাসে চিকিৎসার জন্য আট সপ্তাহের জন্য প্যারোলে মুক্তি পান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন। পরপর তিন দফায় সরকার গঠন করেন তিনি।

দুর্নীতি মামলায় কারান্তরীণ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ১ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা চলছে। ৭২ বছর বয়সী খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তার প্যারোলে মুক্তি ও চিকিৎসা নিয়ে নানামহলে গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে। এরই মধ্যে গত রোববার (পহেলা বৈশাখ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন নেতা। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা, তার চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলাপের পরদিন রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্যারোলের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিতে যে আলোচনা চলছে সেটা তার (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া) এবং তার পরিবারের বিষয়। এর একদিন পর মির্জা ফখরুল আবার বলেন, খালেদা জিয়া মুক্তি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

গত রোববার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নেতাদের একজন খোলা কাগজকে জানান, ওই দিন দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার প্যারোলে মুক্তির প্রসঙ্গেও কথা হয়। তিনি জানান, এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে ম্যাডাম কিছুটা সময় চুপ করে থাকেন। এরপর বলেন, ‘সম্মান হারিয়ে রাজনীতি নয়। আমি তো দোষ করিনি।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী একটি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তারা যেমন উদ্বিগ্ন, তার পরিবারের সদস্যরাও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। পরিবারের সদস্যরাই চান বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসা যেন হয়। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি বা জামিনের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকেই আবেদন করতে হবে। তবে এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়ারই। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের মধ্যকার বাজে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিকল্প দেখছে না বিএনপির বেশির ভাগ নেতা। তবে সিদ্ধান্তের জন্য ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় দলটির নীতি-নির্ধারকরা।

 
Electronic Paper