জামায়াত নিয়ে ধোঁয়াশা
প্রত্যাবর্তন বিলুপ্তি সংস্কার?
রহমান মুফিজ
🕐 ১১:১৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুর বহিষ্কারের ঘটনার পর থেকে দলের ভেতরে-বাইরে চাপে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরের ভূমিকায় ক্ষমা চাওয়া, দল বিলুপ্ত করে নতুন নামে আবির্ভূত হওয়া বা দলের মধ্যে সংস্কার আনার ব্যাপারে শীর্ষনেতারা কী ভাবছেন তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে জামায়াত নিয়ে ধোঁয়াশা ততই বাড়ছে। খোদ দলীয় কর্মীদের মধ্যেই এ নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। জামায়াত কোন পথে- তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, গত শুক্রবার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ ও শনিবার শিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর বহিষ্কারের ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে জামায়াতের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কঠোর দলীয় শৃঙ্খলার কারণে জামায়াতের কোনো গোপনীয় বিষয় যেখানে কখনো প্রকাশ্যে আসে না সেখানে আব্দুর রাজ্জাক ও মঞ্জুর মাধ্যমে দলের মধ্যে গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নানা দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কথা চলে আসে গণমাধ্যমে। ফলে জামায়াত কর্মী-সমর্থকরাই এতে বিচলিত হয়ে পড়েন। রাজ্জাকের নেতৃত্বে জামায়াত ভেঙে নতুন দল আসার সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। এমনকি সে দলে জামায়াতের সবচেয়ে নবীন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি সম্পৃক্ত হতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ ও মঞ্জুর বহিষ্কারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দলের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীলদের কাছে জরুরি নোটিস পাঠিয়েছে। ওই নোটিসে জানানো হয়েছে, জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মজলিসে শুরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন নামে সংগঠন গড়ে তোলা হচ্ছে। এজন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত দলের দায়িত্বশীলদের যথাসময়ে জানানো হবে। এর বাইরে কারও আবেদন, নিবেদন ও অনুরোধে কেউ যেন সাড়া না দেয় সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে নোটিসে।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং দল বিলুপ্ত করার পরামর্শ দিয়ে গত শুক্রবার পদত্যাগ করেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের প্রধান কৌঁসুলি দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এর পরদিন দলের মজলিসে শুরার সদস্য ও রাজ্জাক অনুসারী হিসেবে পরিচিত মজিবুর রহমান মঞ্জু দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এর প্রভাব পড়ে দলের বিভিন্ন স্তরে।
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতকেও বিচারের মুখোমুখি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের একটি খসড়া প্রস্তত করে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। এমনই প্রেক্ষাপটে জামায়াতের বিলুপ্তি, নতুন নামে সংগঠন গড়ে তোলা, তাকে অরাজনৈতিক বাতাবরণ দেওয়া এবং সেই সঙ্গে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব জামায়াতের লোকদের দিয়েই প্রকাশ্যে আনার ঘটনা নানামাত্রিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দলটির যখন বিচারের মুখোমুখী হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে তখন দলটির বিলুপ্তি বা সংস্কারের কথা উঠছে। এমনকি একাত্তরের ঘটনার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নটিও উঠে আসছে। কিন্তু এ সবই জামায়াতের নাটক। দলকে বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর কূট-কৌশল। একাত্তরের পর জামায়াত এ দেশে নিষিদ্ধ ছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী জামায়াতের রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ‘ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে তারা সক্রিয় ছিল রাজনীতিতে। পরবর্তীতে অনুকূল পরিবেশ বুঝে আসল চেহারা ‘জামায়াতে’ই ফেরে তারা।
কেউ কেউ বলছেন, জামায়াত নেতাদের পদত্যাগ ও বহিষ্কারের ঘটনাও তাদের কৌশলেরই অংশ। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নটি তুলে মূলত জামায়াতকে ‘প্রশ্নহীন’ করে তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন তারা। কিন্তু জামায়াত যে নামেই আসুক তার চরিত্র পাল্টানোর সুযোগ নেই। ক্ষমা চাইলেই একাত্তরের অপরাধের জন্য তাদের ক্ষমা করারও সুযোগ নেই। এজন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বেগতিক দেখে তারা খোলস পাল্টাতে চাইছে। এই সময় যদি জামায়াত বিলুপ্ত হয় তাহলে তো নিষিদ্ধের হাত থেকে প্রচ্ছন্নভাবে তারা রক্ষা পায়। একই সঙ্গে নতুন নামে রাজনীতির একটা মওকাও জোটে। কর্তৃত্বহারা হয়ে যাওয়া বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতেই জামায়াত এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেও জানাচ্ছেন অনেকে।
জামায়াত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, মূলত একাত্তরের ভূমিকা, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র, নারী অধিকার ও সহাবস্থানের মতো কিছু গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নে দলে দীর্ঘদিন ধরে মতবিরোধ চলে আসছিল। দলের পুরনো নেতারা এসব বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখাননি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতার ফাঁসি কার্যকর, কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এসব ঘটনার পর নজিরবিহীন সন্ত্রাসী কার্যক্রম দলটিকে রাজনীতিতে কোণঠাসা করে দিয়েছে। গত এক দশকে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন সমাজে রীতিমতো অচ্ছুৎ অবস্থায় পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষের বর্জনের মুখে পড়েছে তারা। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হচ্ছে গোপনে। ফলে সর্বত্রই দলের কর্মী-সমর্থক সংখ্যা যেমন কমছে নতুন করে কেউ তাদের মতাদর্শের দিকে ঝুঁকছে না। এ বাস্তবতায় দলের তরুণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি দলের শীর্ষ নেতাদের ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছিল-জামায়াত যেন একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায় এবং দলে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনে। দলকে যুগোপযোগী অর্থাৎ মর্ডারেট ইসলামিক দলে পরিণত করার চেষ্টায় রয়েছে এ অংশটি। তারা মনে করে প্রয়োজনে নতুন নামে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। জামায়াতের চিহ্নিত কোনো নেতা তার দায়িত্বে থাকবে না।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়েই তারা মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করবে। আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বেই এ অংশটি কাজ করছিল এতদিন। কিন্তু দলের ভেতরে নানা সময়ে প্রস্তাব-পরামর্শ দিয়েও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন তিনি পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে তিনি সেসব কথাও উল্লেখ করেন। বিশেষ করে এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে আব্দুর রাজ্জাক ফের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে জামায়াতে প্রয়োজনে সংস্কার, প্রয়োজনে বিলুপ্তির পরামর্শ দেন। কিন্তু জামায়াত কোন পথে যাচ্ছে, তা নিয়ে খোদ দলীয় কর্মীদের মধ্যেই এখনো বিভ্রান্তি কাজ করছে। কয়েকদিন আগে পাঠানো নোটিসেও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বক্তব্য সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন কেউ কেউ। সেখানে বলা হয়েছে নতুন সংগঠন গড়ার জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। আবার একই সঙ্গে বলা হয়েছে, দলের বিভিন্ন স্তরে কথা বলে তারা জেনেছেন কেউ নতুন সংগঠন গড়ার ব্যাপারে সাড়া দেননি। তাহলে কী চাইছে জামায়াতের শীর্ষনেতারা, তা স্পষ্ট নয়।