ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নতুন বোতলে ফিরছে জামায়াত!

রহমান মুফিজ
🕐 ১০:৫৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯

নতুন নামে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ এবং পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে তকমা লেগেছে, নতুন নামকরণের মধ্য দিয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দলটি। তবে নাম নতুন ধারণ করলেও জামায়াতের ‘চরিত্রে’ কোনো নতুনত্ব বা বদল আসছে না। নতুন বোতলে পুরনো মদের মতোই ফিরছে জামায়াত। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ খবর জানিয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অপরাধে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ও প্রতীক হারানো জামায়াত বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে।

বিশেষ করে ২০১৩ সালে দলের সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় এবং পরবর্তীতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন রায়ের পর দেশব্যাপী চালানো নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে বাধ্য হয় দলটি। এর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে উপর্যুপরি বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ায় কার্যত নেতৃত্বশূন্য ও অচল হয়ে পড়ে দলটি। প্রকাশ্যে দলটি কোনো কর্মসূচি পালন করছে না। তবে গোপনে ও সীমিত পরিসরে চালাচ্ছে কার্যক্রম।

এর মধ্যে জোটসঙ্গী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও মানুষের সমর্থনের ছিটেফোঁটাও জোটেনি তাদের। উপরন্তু জামায়াতকে ধীনের শীষ প্রতীক দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপি ও ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে। রাজনীতিতে জামায়াত এখন অনেকটা ‘অচ্ছুৎ’ ও ‘বর্জিত’ অবস্থায় রয়েছে। সেখান থেকে তাদের টেনে তুলতে পারছে না নানা বাস্তবতায় বিপর্যস্ত বিএনপিও। এ অবস্থায় নতুন নামে রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আসার কৌশল গ্রহণ করেছে জামায়াত। এমনকি কেউ কেউ জামায়াতকে বিলুপ্ত করারও পরামর্শ দিয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জামায়াত থেকে পদত্যাগ করার পর নতুন করে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা না চাওয়ায় জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি দলের আমির মকবুল আহমদের কাছে লিখিত পদত্যাগপত্রে দলকে বিলুপ্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন।

দলটির একাধিক শীর্ষস্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মতানুসারীদের সংখ্যাই জামায়াতে সবচেয়ে বেশি। দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকর্মী একাত্তরের দায় নিতে চান না। উপরন্তু দলের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য ‘ক্ষমা চাওয়ার’ চাপ ছিল শীর্ষ নেতাদের ওপর। জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের অধিকাংশের বয়স পঞ্চাশের নিচে এবং একাত্তরের সময় তাদের জন্মও হয়নি। কিন্তু জামায়াতের কৃতকর্মের অভিঘাত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। এটা তারা চান না।

পাশাপাশি দলের নামে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি জনমনে তৈরি হয়েছে-এ অবস্থায় দলকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এর মধ্যে সরকারও আইন সংশোধন করে জামায়াতের বিচারের পথ তৈরি করছে। ফলে ‘জামায়াতে ইসলামীর’ রাজনীতির কোনো বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না দলসংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতিতে গত জানুয়ারি মাসে দলটির মজলিশে শূরার বৈঠকে দলের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন শূরা সদস্যরা। দলের পরিবর্তিত নাম কী হবে তা এখনই জানা না গেলেও, নাম পরিবর্তনের পক্ষে দলের অধিকাংশ শূরা সদস্য মত দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দলটির সংশ্লিষ্ট সূত্র।

সূত্র জানায়, দলের এ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নাম পরিবর্তন একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। দলের আদর্শ ও দর্শনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এ কৌশল ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো পথ খোলা নেই। এমনকি একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য যদি জামায়াত ক্ষমাও চায়, তারপরও ‘জামায়াত’ নামটি নিজেদের রাজনৈতিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন ও বিকল্প দলটির ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ ও উৎসাহ কেমন- সেটাও দেখতে চায় জামায়াত। মানুষের সাড়া পেলে নতুন দল দাঁড়াবে আর না হলে পুরনো দলেই ফিরবেন তারা।

কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী নাম বলবৎ রেখে গোপনে কাজ করার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে। পাশাপাশি তারা প্রস্তাব দিয়েছেন, অরাজনৈতিক মোড়কে নতুন সংগঠন গড়ে তুলে দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামায়াত-শিবিরকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার। সে সংগঠনে জামায়াতের পরিচিত কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা গণভিত্তি তৈরির কাজ করবে।

দলের নাম পরিবর্তন বা দল গোপনে বলবৎ রেখে নতুন ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন গড়ে তোলা- সব প্রস্তাবই বিবেচনায় নিচ্ছেন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। শিগগিরই এ ব্যাপারে নির্বাহী পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। নামও ঠিক করবেন তারা।

এদিকে নাম পরিবর্তন করে রাজনীতিতে জামায়াতের সক্রিয় হওয়ার এ খবর চাউর হওয়ার পর রাজনীতিতে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন, জামায়াত নাম পরিবর্তন করলেও তার চরিত্র পরিবর্তন হবে না। তার অন্তর্জাত দর্শন মওদুদীবাদ। মওদুদীবাদের হাত ধরেই এ দেশে ধর্মের নামে রাজনীতি ও হত্যার ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়েছে। ফলে জামায়াত যতই নাম পরিবর্তন করুক তাদের ধাপ্পাবাজি সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝে ফেলবে।

 
Electronic Paper