বিএনপির তিন শর্ত
রহমান মুফিজ
🕐 ১১:১৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০১৯
তিন শর্তে বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদে অংশ নেবে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, ২৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা ৯০ হাজার মামলা প্রত্যাহার এবং স্বাভাবিক রাজনীতির সুযোগ পেলেই বিএনপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেবেন এবং সংসদ কার্যক্রমে অংশ নেবেন।
ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বর্জন এবং পুনর্নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচির মধ্যে থাকা বিএনপি এখনো পর্যন্ত সংসদে যাবে কি না সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না জানালেও দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের তিন শর্ত পূরণ করলে তারা অবশ্যই সংসদে যাবে।
সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয় পাওয়া মাত্র ছয়টি আসন নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সংসদে যাবে কি না-তা নিয়ে শুরু থেকেই চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। গত ৩ জানুয়ারি নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ সম্পন্ন হলেও ঐক্যফ্রন্টের দুই দল-বিএনপি ও গণফোরামের নির্বাচিত ৮ সংসদ সদস্য এখনো পর্যন্ত শপথগ্রহণ করেননি।
এরই মধ্যে সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি (জাপা) আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করে গত ৯ জানুয়ারি সংসদ সচিবালায় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২টি আসনে জিতে সংসদে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় যাচ্ছে তারা।
গত দশম সংসদেও প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে জাপা। যদিও ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকেরও বেশি আসন জিতে আসা সরকার ও বিরোধী দল নিয়ে গত সংসদ নানা মহলের কাছে সমালোচিত হয়েছে। অস্বস্তি ছিল গোটা সংসদেও। কিন্তু এবারের অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন সব পক্ষের অস্বস্তি কাটিয়েছে। তবে নির্বাচনে বিএনপির মতো একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা দলের এমন অভাবনীয় ভরাডুবি দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না অনেকেই। মাত্র ছয়টি আসন পেয়ে দলটির নেতা-কর্মীরা রীতিমতো স্তম্ভিত।
এ সংখ্যক আসন নিয়ে সংসদে প্রভাবশালী কোনো বিরোধী দলের ভূমিকায়ও যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। তার চেয়ে সংসদের বাইরে থেকে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই দলটির জন্য শ্রেয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। আবার অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বিএনপির সংসদে যাওয়া উচিত। তারা সংসদে গেলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ যেমন প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি দলও উপকৃত হবে।
যদিও কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, বিরোধী দল শুধু সংসদেই হয় না, সংসদের বাইরেও বিরোধী দল হয়। গত ১৩ জানুয়ারি নাইকো দুর্নীতি মামলায় শুনানির সময় আদালতে আইনজীবীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা রাজপথে থাকে, জনগণের কথা বলে, মানুষের অধিকারের কথা বলে তারাই বিরোধী দল।’ দলীয় চেয়ারপারসনের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে বিএনপির অবস্থান। তারা সংসদের বাইরে থেকেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চায়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইও জারি রাখতে চায়। কিন্তু লড়াই করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি হারিয়ে ফেলেছে দলটি। গত ১০ বছর রাজপথে টানা লড়াই-সংগ্রাম চালাতে গিয়ে অনেকটা ক্লান্ত ও নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বিএনপির মতো বৃহৎ ও গণভিত্তিসম্পন্ন দল। ২০০৯ থেকে ২০১৪-এই সময়ে তারা সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ছিল।
২০১৪ সালের দশম নির্বাচন বর্জন করার পর থেকে দলটি ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ে। বিশেষ করে দশম জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলনের নামে ব্যাপকভিত্তিক সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে দলটি জনসমর্থনও হারিয়েছে অনেকটা। জামায়াতের মতো ‘যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী’ দল জোটসঙ্গী হওয়ায় বিএনপির মতো গণসম্পৃক্ত দলের এ দশা হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। নানা জায়গা থেকে আলোচনা-সমালোচনা ও পরামর্শ পাওয়ার পরও এবারের নির্বাচনেও জামায়াতকে ছাড়তে পারেনি বিএনপি। তারও প্রভাব এ নির্বাচনে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির সূত্রগুলো অবশ্য বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, সরকার গত ১০ বছরে ৯০ হাজার মামলায় বিএনপির ২৬ লাখ নেতাকর্মীকে জড়িয়েছে। অধিকাংশ সক্রিয় নেতাকর্মী এখনো কারারুদ্ধ। টানা নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা-হুমকি দলের কর্মীদের কোণঠাসা করে দিয়েছে। ফলে আন্দোলনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কর্মীরা। তার ওপর নানা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলায় দলের চেয়ারপারসনকে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে সাজা। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমান্ড ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও মামলায় জড়িয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় কাণ্ডারিহীন বিএনপি স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ‘দুর্যোগ’ মোকাবেলা করছে। এরপরও বিএনপি মাঠে থাকার চেষ্টা করছে। অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে কর্মীদের সক্রিয় রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তাও করতে দিচ্ছে না। সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক সহাবস্থান না থাকলে ক্ষমতার সর্বত্রই ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করবে। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের এক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল তাই এবারের জাতীয় নির্বাচনে গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয়েছিল-সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য। দাবি করা হয়েছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। কিন্তু সরকার ও নির্বাচন কমিশন সেটা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ফল একটি ‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি থেকে যে সংসদ শুরু হচ্ছে সে সংসদ একতরফা সংসদে পরিণত হবে। গতবারের মতোই যারা সরকারি দল তারাই বিরোধী দল। বিএনপি এ সংসদে যাবে না। তবে সরকার যদি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দেয়, তার নামে এবং সারা দেশের ২৬ লাখ নেতাকর্মীর নামে করা হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে এবং রাজনীতির মাঠে স্বাভাবিক রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি করে তবে বিএনপি সংসদে যেতেও পারে।
এদিকে সংবিধানের বিধি মোতাবেক সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে কোনো নির্বাচিত সদস্য যদি শপথ না নেন তাহলে তার পদ শূন্য হয়ে যাবে। পরে সেখানে উপনির্বাচন করতে হবে। বিএনপি ও গণফোরামের ৮ সংসদ সদস্য এখনো শপথ নেননি। সংবিধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা শপথ নিচ্ছেন কি না তা-ই দেখার অপেক্ষায় রয়েছে সাধারণ মানুষ।