ঢাকা, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কুড়িগ্রাম-২ আসন

ভোটের আগে জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি

তানজেরুল ইসলাম
🕐 ১২:৩৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩

ভোটের আগে জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি

# জাপা এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
# দুটি ভাগে বিভক্ত কুড়িগ্রাম জাতীয় পার্টি
# উত্তরণে আহ্বায়ক কমিটির কার্যক্রম শুরু

প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রাম জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে কালের বিবর্তনে জেলায় জাতীয় পার্টির ঐতিহ্য ও জৌলুস হারিয়েছে। নড়বড়ে হয়ে গেছে দলটির তৃণমূলের শক্তি। এরশাদের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক পেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। সুবিধাবাদীরা অন্য দল থেকে জাতীয় পার্টিতে অনুপ্রবেশ করেছে। নিজ দলে বঞ্চিত হয়েছে পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এতে দুর্বল হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাতীয় পার্টির অবস্থান। নিজ দুর্গে যখন কোনঠাসা জাতীয় পার্টি তখন পূর্বের জেলা কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। আর এতেই আপত্তি তোলেন কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ। যদিও নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে তাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।

জেলা জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম-২ আসনের জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সুবিধা বুঝে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। যোগদানের পর জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে খ্যাত কুড়িগ্রাম-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাথে জোটের কারণে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

জাতীয় পার্টির নতুন আহ্বায়ক কিমিটির সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের পাত্তা না দিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ। এতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেলা জাতীয় পার্টির পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদ-নদীর ভাঙনরোধে চলমান প্রকল্পে আত্মীয়-স্বজনের নামে মোটা অংকের ঠিকাদারী কাজসহ অনৈতিকভাবে অর্থিক সুবিধা না পেয়ে একজন সুদক্ষ প্রকৌশলীকে তিনি বদলী করান। চলমান প্রকল্প থেকে একজন প্রকৌশলীকে হুট করে এমপি’র ক্ষমতাবলে বদলী করায় এসব প্রকল্পে স্থবিরতা দেখা দেয়।

ক্ষুদ্ধ জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা এসব বিষয় দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে একাধিকবার অবগত করার পর তিনি পূর্বের কমিটি ভেঙে দেন। পরে কুড়িগ্রাম-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে কয়েকবারের নির্বাচিত সাবেক সংসদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাককে আহ্বায়ক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সালামকে সদস্য সচিব করে জেলা জাতীয় পার্টির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। চলতি বছরের ২৭ জুন জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। ওই নতুন কমিটিতে জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব পদে থাকা কুড়িগ্রাম-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক পদ দেওয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ নব গঠিত কমিটিকে চাপে ফেলতে নেপথ্যে থেকে নিজের জলিল বিড়ি কারখানার কর্মচারীদের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী সাজিয়ে জেলা শহরে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন।

কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় শ্রমিক পার্টির সভাপতি মজনুজ্জামান মজনু বলেন, সাবেক কমিটি নেতাকর্মীদের জন্য কিছু করতে পারেনি। বর্তমান এমপি নিজের স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছেন। জেলার শ্রমিকদের জন্য কিছুই করতে পারেননি। তিনি পকেট কমিটি করেছেন। তাকে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কারের জন্য দাবি উঠেছে। আশা করছি কেন্দ্র সেই দাবি পূরণ করবে। জাতীয় পার্টিকে আরো সুসংগঠিত করতে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটিকে সহযোগিতা না করে উল্টো কুড়িগ্রাম জাতীয় পার্টিতে বিভাজন তৈরি করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনি জাতীয় পার্টির হলেও আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টিতে এসেছেন। আবার জাতীয় পার্টিতে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজু করে চলছেন। এতে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা নিগৃহীত ও ক্ষুব্ধ।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা সর্বদা মেনে চলি। নতুন আহ্বায়ক কমিটি জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করি। অনুপ্রবেশকারীরা সব রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষতিকর। বিগত পাঁচ বছরে কুড়িগ্রাম-২ আসনে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। জাতীয় পার্টির উন্নয়ন হয়নি। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের কাছে উন্নয়ন না হওয়ায় জবাবদিহি করতে হবে।

কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, ‘বিগত কমিটি দলের জন্য কাজ করতে পারেনি বলেই কেন্দ্র থেকে আহ্বায়ক কমিটি করে দিয়েছে। বর্তমান আহ্বায়ক কমিটিতে ত্যাগী, নিবেদিত, পরিক্ষীত এবং সামাজিক অবস্থান আছে তাদের স্থান দেয়া হয়েছে।’

জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মেজর (অব.) আব্দুস সালাম বলেন, বিগত কমিটি ২০১৮ সালে গঠন করা হয়েছিল। গত প্রায় পাঁচ বছরে সেই কমিটি কোন আশার আলো দেখাতে পারেনি। দলের জন্য কোনো কাজ করতে পারেনি। জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত করতে পারেনি। উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে দলকে সুসংগঠিত করতে পারেনি। বিগত কমিটিকে কেন্দ্র থেকে বার বার বলা সত্ত্বেও তারা দৃশ্যত ভূমিকা নেয়নি। পরবর্তীতে আমাকে কেন্দ্র থেকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

তিনি আরো বলেন, নতুন আহ্বায়ক কমিটিকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বিব্রত করা হচ্ছে। আহ্বায়ক কমিটিকে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মতে সহযোগিতা না করে উল্টোপথে অবস্থান নিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য। বর্তমান সংসদ সদস্যের কাছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা নিগৃহীত। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক। তারও একটা বড় ভূমিকা আছে। তাকে আমরা দাওয়াত করলেও তিনি আসেন না। তিনি তার বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সামনে রাস্তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা করালেন। উনি বলেছেন পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ করেছে। আসলে বর্তমান সংসদ সদস্যে পদবঞ্চিত হয়েছেন। এর অর্থ, তিনিই বিশৃঙ্খলা করাচ্ছেন। ভাড়া করে শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলন করে দিনশেষে তাদের মজুরি দেওয়া হয়নি। এসব কর্মকাণ্ডে বর্তমান সংসদ সদস্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি জাতীয় পার্টির ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন আহ্বায়ক কমিটি তার মন মতো হয়নি। কমিটিতে অনেক সদস্য। বাইরে জাতীয় পার্টি নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। কিন্তু এটি বিবেচনা না করে ঘরে বসে কমিটি করা হচ্ছে। চায়ের দোকানে এমনকি সেলুনে বসে কমিটি করা হচ্ছে। আবার আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। আমার বিড়ি কারখানার শ্রমিকরা কোথাও আন্দোলন করেনি। নতুন আহ্বায়ক কমিটি আমাকে না জানিয়ে কমিটিগুলো করছে। আমাকে চিঠি পর্যন্ত দেয় না। নতুন আহ্বায়ক কমিটি জাতীয় পার্টিতে বিভাজন তৈরি করেছে। অনেক পুরাতন নেতাকর্মী কমিটিতে স্থান পায়নি।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে কোনো ঠিকাদারি কাজ করে না। আমার পরিবারের কেউ ঠিকাদারি করে না। এগুলো মনগড়া কথা। আমি ব্যবসা করি। ঋণ নিয়েছি। মানুষের কর্মসংস্থান করছি। আর তারা বসে থেকে আমার সমালোচনা করছে। আমার প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। একজন জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তাকে যেই মূল্যায়ন করার কথা ছিল সেটি দল থেকে করা হয়নি। এরকম কমিটি আমি ঢাকায় ঘরে বসে করতে পারি। তবে আমি কোনো পকেট কমিটি করিনি।

 
Electronic Paper