ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রার্থী জটেও ভোটে নির্ভার

রহমান মুফিজ
🕐 ১০:৩৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে হিমশিম অবস্থায় রয়েছে ক্ষতাসীন আওয়ামী লীগ। ৩০০ আসনে ৪০২৩ মনোনয়নপ্রত্যাশীর পাশাপাশি ১৪ দল, মহাজোট শরিক ও অপরাপর মিত্রদের প্রার্থী নিয়েও ভাবতে হচ্ছে দলটিকে। প্রতি আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন গড়ে ১৩ জন। আবার শরিকদের সঙ্গে আসন সমন্বয় করতে গিয়ে ছাড়তে হবে কমসে কম ৭০ থেকে ৭৫টি আসন। এ নিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরে নানা চাপ সামলাতে হচ্ছে দলের মনোনয়ন বোর্ডকে। কিন্তু সে চাপকে তেমন একটা আমলে নিচ্ছে না দলের হাইকমান্ড। কারণ, টানা দশ বছর ক্ষমতায় থেকে শহর থেকে নগরে ভোটারদের মধ্যে দলের যে জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে তাতে অনেকটাই নির্ভার তারা। আসন্ন ভোটে নিজেদের জয় নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী আওয়ামী লীগ।

প্রধান বিরোধী পক্ষ বিএনপি এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএনপিপ্রধান রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী প্রস্তুতির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও তাদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীনরা। কারণ, অনানুষ্ঠানিকভাবে দলটি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে বহু আগেই। বিশেষ করে গত ৮ সেপ্টেম্বর উত্তরাঞ্চল সফরের মধ্য দিয়ে তারা আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী যাত্রা শুরু করে। সে নির্বাচনী যাত্রা চলে সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলেও। এর পর ১ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর সারা দেশে পরিচালিত হয় গণসংযোগ কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নির্বাচনের জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করার পাশাপাশি ভোটারদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী বার্তা। গত ১০ বছরের ক্ষমতাকালে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি ভোটারদের কাছে তুলে ধরেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড়সড় জনসভাও সম্পন্ন করেছে দলটি। সে সময় বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না তা নিয়েই দ্বিধাদ্ব›েদ্ব সময় পার করেছে। তবে গত ১১ নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপিসহ অপরাপর বিরোধী দলের নির্বাচনে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় সারা দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার কোনোভাবেই নির্বাচন বয়কট করার সম্ভাবনা নেই বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। কারণ ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যে ভুল করেছিল এখনো তার খেসারত দিতে হচ্ছে পদে পদে। এবার নির্বাচন বর্জন করলে দলটির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। দলের তৃণমূলের কর্মীরা যে মনেপ্রাণে চাইছিল বিএনপি নির্বাচনে যাক, তার প্রমাণ মিলেছে দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময়। আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৪৫৮০টি। বিএনপি নির্বাচনে আসায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও এক ধরনের স্বস্তি ফিরেছে। তবে দেরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপি এখনো আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে প্রচারণায়। আওয়ামী লীগ এ জন্য কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। তাদের বিশ্বাস আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে গত দশ বছরের উন্নয়নের প্রতিদান দেবে। উন্নয়নের ধারবাহিকতা রক্ষা করতে ভোটাররা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে। সে অনুযায়ী নির্বাচনী প্রস্তুতিও এগিয়ে রেখেছে দলটি। ইতোমধ্যেই শরিক ও মিত্রদের জন্য ৬৫ থেকে ৭০ আসন ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার পর্ব চলছে এখন। দলের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে দল আগে থেকে দেড়শরও বেশি আসনে মনোনয়ন অনেকটা চূড়ান্তই করে রেখেছে তবে ১৪ দলীয় জোট ও মহাজোট শরিক এবং মিত্রদের জন্য আসন ছাড় ও আসন সমন্বয় নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
প্রতিটি আসনে দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় এবার বিদ্রোহী প্রার্থী বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। যদিও দলীয় সূত্র বলছে, সেটা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ মনোনয়ন ফরম কেনার সময়ই প্রত্যেক মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের একক প্রার্থিতা মেনে নিয়ে কাজ করবেন এবং বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন না বলে ‘হলফ’ করেছেন। দলের মনোনয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে প্রার্থী মনোনয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া আছে। তিনি যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষেই সবার কাজ করতে হবে-এমন প্রতিশ্রুতি আগেই নিয়ে নেওয়া হয়েছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পক্ষ থেকে। এরপরও যদি কেউ বিদ্রোহ করে বসেনও তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দল।
গত ১৪ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারের সময় সাফ বলে দিয়েছেন, দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা কেউ করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গেই আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে দেওয়া হবে।
এর পরও দলের বা জোটের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যেন শেষ সময়ে কোনো ধরনের দলাদলি বা গ্রুপিং সৃষ্টি না হয় সে জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী মনোনয়নের কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের অভ্যন্তরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিরস্ত করার কৌশলে অনেকটা সফলও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, দল ক্ষমতায় গেলে প্রত্যেকেই নানাভাবে সুবিধাভোগী হবেন এবং ঝরে যাওয়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে দল থেকে। কিন্তু ১৪ দল, মহাজোট ও মিত্রদের সঙ্গে আসন সমন্বয় কোন কৌশলে করা হচ্ছে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। বিভিন্ন আসনে এ নিয়ে ভোটার ও দলীয় কর্মীদের মধ্যেও বিরাজ করছে বিভ্রান্তি।
বিশেষ করে সেসব আসন নিয়ে সবচেয়ে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে যেসব আসনে রয়েছে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী কিন্তু সেখানে মনোনয়ন চেয়ে বসে আছেন জোট শরিক ও মিত্রদের কেউ কেউ।    
যেমন মহাজোটের সদ্য যুক্ত হওয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট ১০টি আসন দাবি করেছিল। আওয়ামী লীগ তাদের দুটি আসন দিতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে তারা নোয়াখালী-৪ ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসন দাবি করেছে। এ দুটি আসনে রয়েছে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী। নোয়াখালী-৪-এ আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য একরামুল করীম চৌধুরী। সেখানে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান মহাজোটের প্রার্থী হতে চাইছেন। অপরদিকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন চাওয়া হয়েছে বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরীর জন্য। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন ছাত্রলীগের এক সময়ের তুখোড় সংগঠক গোলাম সারওয়ার কবীর। এ আসনে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন মাহী বি. চৌধুরী। গোলাম সরওয়ার কবীরের চাইতে কোনো ক্রমেই মাহী বি. চৌধুরী শক্ত প্রার্থী নন বলেই মনে করছেন সেখানকার আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ফলে এসব আসনে মিত্র বা শরিকদের প্রার্থী মনোনয়ন পেলে স্থানীয় রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। এর পূর্ণ সুযোগ নেতে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট।  
এরকম আসনগুলো নিয়েই আওয়মী লীগের সঙ্গে শরিক ও মিত্রদের দরকষাকষি চলছে। মনোনয়ন নিয়ে চলছে তুমুল লড়াই। শেষ মুহূর্তে আসনগুলোতে কারা কারা মনোনীত হন তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন জোটকর্মী ও ভোটাররা।
প্রসঙ্গত, পুনঃতফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৮ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বর এবং ভোটের দিন ৩০ ডিসেম্বর।

 
Electronic Paper