ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মানবধর্মের গুরু

ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ৬:৪৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০১৮

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই মূল হারাবি।’ লালন মানবতাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। যা লালনের গান থেকেও স্পষ্ট। প্রায় সিংহভাগ গানে প্রেম ও মানবতাবাদ স্পষ্ট। এসব গান থেকে জানা যায়, তিনি না ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী, না ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। লালন সাঁইয়ের প্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পালের মতে, ‘সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, একথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।’

লালনের জীবদ্দশায় তাকে তেমন কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে দেখা যায়নি। যেমন তার একটি গানে তিনি বলছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কী রূপ/আমি দেখলাম না দুই নজরে।’ আসলে তিনি ছিলেন প্রেমিক, মানবতাবাদী। প্রেমই তার প্রার্থনা। মানবতাই তার ধর্ম।
বড় বড় মনীষীরা যেমন সচেতনভাবে তার কাজের বিবরণ, তারিখ ইত্যাদি বিস্তারিত লিখে রেখে জান। মৃত্যুর পর যাতে তাদের আবিষ্কার করা যায়। কিন্তু প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা, প্রাকৃত মানুষ লালন শাহদের মতো লোকেরা নিজের সম্পর্কে ততটাই উদাসীন থাকেন। নিজের নিয়ে তারা ভাববেন কি, তারা তো মানবকল্যাণে উৎসর্গীত প্রাণ। মানুষের মুক্তি হলেই তারা খুশি। সেখানে আবার নাম-কাম খোঁজার কি আছে? তারা ভাবতেই পারতেন যে শত বছর পর কেন, মৃত্যুর পরই বা মানুষের আমার কি প্রয়োজন। বেঁচে থাকতে যা করা যায়, তাই তো মানবকল্যাণে লাগবে! তাই জগদ্বীখ্যাত লোকদের চরিত লেখা যতটা সহজ, লালনের জীবন নিয়ে লেখা ততটাই কঠিন।  
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফকির লালন সাঁই বা লালন ফকির। কথিত আছে, ‘ক্ষমো ক্ষমো মোর অপরাধ’-এ গানটি গাইতে গাইতে তিনি না-ফেরার দেশে চলে যান। লালন ফকিরের জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ‘হিতকরী’-এর তথ্য মতে, ১৭৭৪ সালে তার জন্ম বলে ধারণা করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি একাধারে ফকির (মুসলমান সাধক), দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে প্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তার মৃতুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় প্রথম তাকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।
লালন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসূত্র তার নিজের রচিত অসংখ্য গান। গানে গানে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন। তিনি একজন বাঙালি যার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর প্রামে। লালন সাঁইয়ের জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। এই প্রশ্ন তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রচলিত থেকে অনুমিত হয়েছে যে কথিত আছে, তিনি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু ছেলেবেলায় জলবসন্ত রোগে অসুস্থ অবস্থায় তার পরিবার তাকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। তখন মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান নামের এক মুসলমান দম্পতি তাকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন। মলম সাহ তাকে কোরআন ও হাদিস শিক্ষা দেন এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ফকির সিরাজ সাঁই নামের একজন ফকিরের কাছে পাঠান।
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’-এই তো ছিল তার মতবাদ। মৃত্যুর পরে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান তাই কোনো বিশেষ ধর্ম অনুসারে হয়নি। এমনকি কোনো ইমাম বা পুরোহিতও ডাকা হয়নি। তার উপদেশ অনুসারে, আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভেতর তার সমাধিস্থ করা হয়। তিনি ফকির ছিলেন, কিন্তু বিষয়হীন ফকির ছিলেন না। তিনি সংসারী ছিলেন। সামান্য জমিজমা ছিল। বাড়িঘরও ছিল। মধ্যবর্তী গৃহস্থের মতো গৃহ সরঞ্জামাদিও ছিল। কেউ কেউ বলে তার পানের বরজ ছিল। কৃষিকাজ করতেন। নগদ প্রায় ২ হাজার টাকা রেখে যান। তিনি সামান্য আহার করতেন। শাকসবজির সঙ্গে মাছ খেতে পছন্দ করতেন। শেষ বয়সে তিনি দুধ পান করে জীবন কাটাতেন। তিনি নারকেলের খোলে করে পানি পান করতেন। সাধু সেবার সময় কলাপাতায় খেতে দিতেন।
অবাক করা বিষয় হলো, লালন ফকির প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। সব ধর্মের লোকের সঙ্গেই তার ছিল সুসম্পর্ক।

স্মরণোৎসব
ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার তিথিতে, দোল পূর্ণিমায় লালন ফকির তার আখড়ায় সাধুসঙ্গ করতেন। কালের বিবর্তনে আজ তা লালন স্মরণোৎসবে রূপ নিয়েছে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় প্রতিবছর তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে। আসেন সব শ্রেণির মানুষ। লালনের যারা অনুসারী তারা আসেন, আসেন সাধারণ ভক্তরা। এটি তখন উৎসবের কেন্দ্রে পরিণত হয়।  
তিন দিন সারাক্ষণ মেলা চলে। মেলায় হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসে থাকেন। স্থানীয় লোকের ধারণা এখানে কোটি টাকার ব্যবসা হয়। গ্রাম বাংলার মেলার সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সামগ্রীও পাওয়া যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আর রাজশাহী থেকে কালাই রুটির দোকানিরা আসেন। বসে বাতাসার দোকান, জিলাপি আর পাপড়ের দোকান। বিভিন্ন বয়সের লোকের সমাবেশ ঘটে, নারী শিশুরাও পিছিয়ে থাকেন না। মেলার কদিন লালন ফকিরের সমাধিতে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে। আলোকসজ্জা করা হয়।
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় লালন মঞ্চে আলোচনা হয়। চারদিকে রঙিন বাতি জ্বালানো হয়। লালন গবেষকরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তারপর শুরু হয় সংগীত পরিবেশনা। খ্যাতিমান শিল্পীরা আসেন। তাদের পাশাপাশি সাধকরাও গান পরিবেশন করেন। ভোর পর্যন্ত চলে এ অনুষ্ঠান। সকালের দিকে লোকসমাগম কম থাকে। দুপুরের পর থেকে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। একসময় তা জনস্রোতে পরিণত হয়। সাধুরা অবশ্য পূর্ণিমা শুরুর আগেই আসেন। শুরু করেন অধিবাস।

তিরোধান দিবস
কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় লালন তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানও পাঁচ দিনব্যাপী। জনশ্রুতি আছে, আশ্বিস মাসের শেষদিকে লালন ফকির তার অনুসারীদের বলেছিলেন, তোমরা সবাই কার্তিকে প্রথম দিন এই আখড়ায় উপস্থিত থাকবে। ওইদিন এখানে রোজ কিয়ামত হবে। সবাই এসেছিলেন। সারা রাত আলোচনা চলে, মাঝে মাঝে গান। শেষ রাতের দিকে তিনি গান গাইতে গাইতে ভক্ত-অনুসারীদের কাঁদিয়ে এই ধরাধাম ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে তার ভক্ত অনুসারীরা এই দিনটিকে পালন করেন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। এ অনুষ্ঠান আগে হতো লালনের সমাধির পাশে। কালের বিবর্তনে এখন তা পালিত হয় সামনের মাঠে।
এ উপলক্ষে আখড়াবাড়ির লালন মাজারকে সাজানো হয় নানা সাজে। ছেঁউড়িয়ার বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির আখড়াবাড়িতে সেই মেলা উপলক্ষে লালনের মাজার প্রাঙ্গণে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দূর-দূরান্ত থেকে সাধু ভক্তরা এসে আসর বসায়। উৎসব উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে বিদেশ থেকেও আসেন অসংখ্য লালন ভক্ত।

গুরু সিরাজ সাঁই
‘দিব্যজ্ঞানী যে জন হলো/নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেলো/সিরাজ সাঁই লালন রৈলো/জন্ম-অন্ধ মন-গুনে।’ লালনের গানে সিরাজ সাঁইর নাম। সিরাজ সাঁই ছিলেন বাঙালি বাউল সাধক এবং দার্শনিক, যিনি ফকির সিরাজ, দরবেশ সিরাজ, সিরাজ সাঁই, সিরাজ শাহ ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বাউল সম্রাট লালন তার কাছে বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং জীবদ্দশায় লালন তার বহু গানে সিরাজ সাঁইয়ের কথা উল্লেখ করেন। লালনের গুরু হিসেবেই পরবর্তীতে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার হরিশপুর গ্রামে সিরাজ সাঁইয়ের সমাধি অবস্থিত। এ প্রসঙ্গে আবুল আহসান চৌধুরী তার ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘লালন সাঁই বাউলসাধনার সিদ্ধ-পুরুষ। কাহার-সম্প্রদায়ভুক্ত সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর তার প্রকৃত সাধকজীবনের সূচনা। (পৃষ্ঠা, ২৩)।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper