একজন মিসাইলম্যান
রাশেদ রহমান
🕐 ৩:০০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০১৮
পত্রিকার হকার থেকে ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি-এ বোধহয় এ পি জে আবদুল কালামের পক্ষেই সম্ভব। ‘যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে সেটা স্বপ্ন নয়, যেটা ঘুমাতে দেয় না সেটাই স্বপ্ন’-আবদুল কালামের এমন অনেক বক্তব্য প্রেরণা জুগিয়ে চলছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে। আমৃত্যু স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ১৯৩১ সালে এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন আপাদমস্তক স্বপ্নবাজ এ মানুষটি। ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই...
রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী, লেখক-কী ছিলেন না এ পি জে আবদুল কালাম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন কোটি কোটি মানুষকে। বক্তৃতা করতেই ভালোবাসতেন তিনি। আর বক্তৃতার মাঝেই তিনি প্রয়াত হন। পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই প্রয়াত হন এই অসাধারণ মানুষটি।
এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি। ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেও কথা বলতে ও শোনাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম, সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠান থেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি। মেঘালয়ের শিলংয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কালাম, সেখানেই হঠাৎ ঢলে পড়ে যান তিনি। তখন তার বয়স ৮৪ বছর।
দেশের মানুষ ভালোবেসে তাকে ডাকত ‘মিসাইলম্যান’ নামে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তার অবদানের জন্য তাকে এ নামে ডাকা। জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর অধুনা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে। তিনি পদার্থ ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ৪০ বছর প্রধানত রক্ষা অনুসন্ধান ও বিকাশ সংগঠন (ডিআরডিও) ও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো) বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। ভারতের অসামরিক মহাকাশ কর্মসূচি ও সামরিক সুসংহত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলেন।
মিসাইলম্যান এ পি জে ছিলেন একদম সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। ছিলেন অবিবাহিত। দেশের জন্য অকাতরে শুধু নিজেকে সপে দিয়েছেন। নিজেকে সাধারণের কাতারে দাঁড় করিয়ে সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। সম্ভবত এ জন্য ই নিরহংকারী মানুষটি ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ হতে পেরেছিলেন। ছোট শহরের এক মৎস্যজীবী পরিবারে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিলেও তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। জয়নুল আবেদিন মাঝির ছেলে কালাম। খেয়ে-না-খেয়ে পড়াশোনা করেছেন। এক সময় চেয়েছিলেন পাইলট হবেন কিন্তু হয়েছিলেন পরমাণুবিজ্ঞানী। ভারতের পারমাণবিক ক্ষেত্র সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করেছে যার হাত ধরে, তিনি এ পি জে আবদুল কালাম।
১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পরমাণু বোমা পরীক্ষায় তিনি প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হন।
প্রতিভাবান এ বাগ্মী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেতেন তরুণদের জাগিয়ে তুলতে। তরুণদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন দুই দশকে ১ কোটি ৮০ লাখ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে তার। আত্মবিশ্বাসী মানুষটি যেখানে গিয়েছেন, জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করে দিয়ে এসেছেন। তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের চিন্তাচেতনার আলো। তরুণদের মনে দারুণভাবে দাগ কেটেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের এ মহিরুহ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তরুণ-তরুণীদের মনকে আন্দোলিত করতে ছুটে যেতেন তিনি। স্বপ্ন দেখাতেন তরুণদের। আর এ কাজে তার না ছিল কোনো ক্লান্তি, না ছিল কোনো অলসতা। জীবনের শেষদিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ কাজ করে গেছেন। বয়সের ভারও যা ¤øান করতে পারেনি।
ইন্ডিয়া টুয়েন্টি টুয়েন্টি, মিশন ইন্ডিয়া, মাই জার্নি, টার্নিং পয়েন্ট, ইগনাইটেড মাইন্ড তার উল্লেখযোগ্য রচনা।
আব্দুল কালামের আত্মজীবনী ‘উইংস অফ ফায়ার’ তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রকাশিত হওয়ার পর বইটির ১০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়।
এ পি জে আবদুল কালাম একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। ২০১৪ সালে ঢাকা সফরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে রাখা বক্তব্যে দুটি কারণে বাংলাদেশকে ভালো লাগার কথা জানান তিনি। প্রথমত, নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিস্তৃত জলরাশি, দ্বিতীয়, কারণ উন্নত পোশাক শিল্প। জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তবে জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা যা তিনি পেয়েছেন। মানুষ তার কাজের জন্যই তাকে মনে রাখবে।
প্রকৃতিপ্রেমী
একবার তিনি দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ লাগানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, নিরাপত্তার জন্য দেয়ালের ওপর ভাঙা কাঁচ লাগানো হলে এটি পাখি দাঁড়াতে পারবে না। কুলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ঘটনাটি ঘটেছিল যখন তিনি ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থায় (ডিআরডিও) কাজ করেন, সে সময়ে। গবেষণাগারের নিরাপত্তা বাড়াতে দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ লাগানোর চিন্তা করছিল তার দল।
মুচিকে আমন্ত্রণ
রাষ্ট্রপতি হিসেবে কালামের প্রথম সফর ছিল কেরালার রাজ্যের রাজধানী থিরুভানান্তপুরাম। রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন আবদুল কালাম। তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাস্তার পাশের এক মুচি ও ছোট একটি হোটেলের মালিককে। বিজ্ঞানী হিসেবে থিরুভানান্তপুরাম থাকার সময় ওই দুজনের সঙ্গে কালামের ভালো সম্পর্ক ছিল।
নো টেলিভিশন
ড. আবদুল কালামের বাড়িতে কখনোই টেলিভিশন ছিল না। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে দিনের কাজ শুরু করতেন; রাত ২টা পর্যন্ত জেগে থাকতেন। তিনি রেডিও শুনতেন, বেশির ভাগ সময়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও শুনতেন। ড. কালামের ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিয়মিত তাকে দেখে যেতেন; কিন্তু তিনি কখনো কোনো অসুস্থতার কথা বলেননি।
স্কুলছাত্রের প্রশ্নে লা-জবাব
‘একজন শিক্ষার্থী আমাকে প্রশ্ন করেছে এবং আমি তাকে উত্তরটি দিয়েছি সেটি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। সে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, আমার এমন কি অবদান আছে সেটি সত্যিকার অর্থে অনন্য। আমি আসলে উত্তরটা জানি কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না।’ এ নিয়ে ড. কালাম সত্যিকার অর্থেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছেন। দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তার উদ্বেগ রয়েছে। সেখানে একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষার্থীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়াটাও তার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ!