সমাজ সংষ্কারক কাঙ্গাল হরিনাথ
লিটন ঘোষ জয়
🕐 ১:৪৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৮, ২০২১
সারাজীবন অবহেলিত গ্রাম-বাংলায় শিক্ষা বিস্তার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন কাঙ্গাল হরিনাথ। অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন সাহিত্য সাধক, সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ। তাকে নিয়ে লিখেছেন লিটন ঘোষ জয়।
সাহিত্য সাধক সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ
হরিনাথ মজুমদার (জন্ম ২২ জুলাই : ১৮৩৩, মৃত্যু : ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬) বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার কুমারখালি (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতা লোকান্তরিত হন। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার।
বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। তবে সারাজীবন অবহেলিত গ্রাম-বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি। অতঃপর গোপাল কু-ু, যাদব কু-ু, গোপাল স্যান্যাল প্রমুখ বন্ধুদের সাহায্যে ১৩ জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাথ মজুমদার। এরপর বেশ কিছুদিন ওই বিদ্যালয়েই বিনাবেতনে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তারই সহায়তায় ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
সাংবাদিকতা
অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীন সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজ গ্রামের লোকের ওপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ^রচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙ্গাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্বন] যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা।’
শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশি জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ গ্রামেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী’র অর্থ আনুকূল্যে কাগজ চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়। আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে হরিনাথের মনে যে প্রতিকারচিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন।
গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা
কাঙ্গাল হরিনাথের আবির্ভাব হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে; বাংলা ১২৭০ সালের পহেলা বৈশাখ। পত্রিকাটি অনুপ্রাণিত করেছে বিপ্লবীদের। আবার আঘাত করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের মূলে। সেই সময়ের কুষ্টিয়া থেকেই বিপ্লবী বাঘা যতীনের উত্থান, জমিদার দর্পণ-এর নাট্যকার মীর মশাররফ হোসেনের ক্রমশ বিপ্লবী লেখক হয়ে ওঠা এবং লালনের বিপ্লবী ন্যাংটা বাহিনীর ইংরেজ লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। হরিনাথের সাহস আর সংগ্রামে কেঁপে উঠেছিল শাসকগোষ্ঠী, যাকে হত্যা করার জন্য ইংরেজদের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তার লেখনীই বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অবহেলিত সমাজের বৈষম্য ও জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে তিনি প্রথমে মাসিক পরে পত্রিকাটি পাক্ষিক ও তার কিছু পরে সাপ্তাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এক পয়সা মূল্যের এই পত্রিকাটিতে কাঙ্গাল হরিনাথ অবিরাম নীলকর ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের জমিদারের নানা অনাচার-অত্যাচারের কথা প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে কুষ্টিয়ার এম.এন প্রেস নামে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। একদিকে অর্থের অভাব অন্যদিকে সরকারের কঠোর মুদ্রণনীতি ও নানা বিরোধিতায় মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে প্রায় ২২ বছর প্রকাশের পর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়।
অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি হরিনাথ সে সময় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’কে ঘিরে লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। ফলে এ পত্রিকার মাধ্যমে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিক সৃষ্টি করে গেছেন হরিনাথ। হরিনাথের স্নেহধন্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন রচিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সার্থক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ হরিনাথের এমএন প্রেস থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। লালন সাঁইজীর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’সহ মোট ২১টি গান সর্বপ্রথম মুখের শব্দ থেকে কাগজে ছাপার অক্ষরে ঠাঁই পায় কাঙ্গালের এমএন প্রেসের মুদ্রণে।
বাউল সঙ্গীত
দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগপূর্বক ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাত্মিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বাউল সঙ্গীতকে সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মানসে ঊনবিংশ শতকে যে কয়েকজন সাহিত্য সাধক সাহিত্যে নিয়োজিত হয়েছিলেন, কাঙ্গাল হরিনাথ তাদের মধ্যে অন্যতম। যে যুগে হরিনাথ সাহিত্য সাধনা করেন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাষা ও কল্পনার যুক্তভঙ্গি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়। ১২৮৭ সালে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় ও রায় জলধর সেন প্রত্যক্ষ আগ্রহ আর সহযোগিতায় ‘ফিকির চাঁদ ফকিরের দল’ গঠনের মাধ্যমে বাউল গান রচনা, প্রসার-প্রচারের যাত্রা শুরু করেন। বাউল গানের দল গঠনের অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন লালন সাঁইজীর কাছে। কাঙ্গাল হরিনাথ ছিলেন লালন সাঁইজীর ভাবশিষ্য।
‘কাঙ্গাল’ ও ‘ফিকির চাঁদ ফকির’ নাম ভনিতায় রচনা করেছিলেন অসংখ্য বাউল গানসহ অন্য ভাবধারার সঙ্গীত।
ঘুমন্ত নিরক্ষর হৃদয়কে আঘাত হানতে রচিত সংগীতে তিনি ব্যবহার করলেন সহজ ভাব রূপকের দ্যোতনা। কাঙ্গাল রচিত প্রথম গান হিসেবে পরিচিত গানটিতেই নশ^র প্রাকৃতিক মোহের ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান-
‘ভামন দিবানিশি অবিনাশী/সত্য পথের সেই ভাবনা,
যে পথে চোর ডাকাতে কোনমতে/ছোঁবে নারে সোনাদানা’।
ধর্মান্ধতার মধ্যেই যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প লুকিয়ে সে কথা কাঙ্গাল ভাব-সঙ্গীতের মাধ্যমে বোঝাবার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। পরহিতব্রত সমাজ সংস্কারক হরিনাথকে অনেক বেশি মাত্রায় মানবিকতার দীক্ষায় দীক্ষিত করেছিল। সেই মানবিকতার জায়গা থেকেই তিনি হিন্দু-ব্রাহ্মের বিবাদ মীমাংসায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলন-প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছেন। মূলোৎপাটন করতে চেয়েছেন ধর্মীয় বর্ণবাদের। এই মানবিক মূল্যবোধের চর্চার কারণেই তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ পর্যায়ের পূর্ব বাংলার সমসময়ের হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদের নিন্দা করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিচলিত করেছিল।
এ প্রসঙ্গে আবুল আহসান চৌধুরী তার ‘কাঙ্গাল হরিনাথ বাউলগানের অনুষঙ্গে’, (কালি ও কলম-১ মার্চ, ২০১৬) সংখ্যায় লিখেছেনÑ “মরমিগানের সঙ্গে কাঙ্গাল হরিনাথের সম্পর্ক অতি নিবিড়। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘শখের বাউল’ হিসেবে তার আবির্ভাব হলেও শেষ পর্যন্ত এই বাউলগানের সূত্রেই হরিনাথ তার সাধন-অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন এবং তার শিল্প-শক্তির যথার্থ পরিচয়ও এর মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। তার লোকপ্রিয়তা ও পরিচিতির মূলেও রয়েছে এই বাউলসংগীত। তার জীবনদর্শন, অধ্যাত্মভাবনা ও মরমি-মানসের পরিচয় বিধৃত রয়েছে এসব গানে। এ প্রসঙ্গে জলধর সেন লিখেছেন :
কাঙ্গাল হরিনাথ, পূর্ববঙ্গের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার নিকটে তাহার বাউলসঙ্গীতের দ্বারাই অসামান্য লোক বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। এই বাউলসঙ্গীতের সহজ সরল প্রাণস্পর্শী কথায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবর্বশ্রেণির লোকই মুগ্ধ হইতেন। অল্পদিনের মধ্যে বাউলসঙ্গীতের মধুর উদাস সুর হাটে, ঘাটে, মাঠে, নৌকাপথে সবর্বত্রই শ্রুত হইত। হরিনাথ বাউলগানের একটি ভিন্ন ‘ঘরানা’ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ‘কাঙ্গাল’ ও ‘ফিকিরচাঁদ’ ভণিতায় পরমার্থসূচক যেসব বাউলাঙ্গের মরমিগান রচনা করেন তার সংখ্যা প্রায় হাজারের কোঠায়। তার এই বাউলসংগীতের স্বরূপ ও জনমনে তার প্রভাব সম্পর্কে জানা যায় :
অনেক সঙ্গীতে সংসারের অনেক সুখ-দুঃখের কথা ধ্বনিত হইয়াছে বটে, কিন্তু কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলসঙ্গীতে হৃদয়ের মধ্যে যেমন সংসারের অনিত্যতা, ঈশ^রের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমভাব জাগাইয়া তুলে, এমন আর কিছুতেই নহে।
রূপের গর্ব, ঐশ্বের্যের অভিমান, বাসনার আসক্তি হইতে মানুষ আপনাকে যদি নির্মুক্ত করিতে চাহে, তাহা হইলে তার পক্ষে হরিনাথের সঙ্গীত এক অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র-স্বরূপ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহী, রঙ্গপুর প্রভৃতি জেলার অনেক লোকই কাঙ্গাল হরিনাথের এই সকল সাধন সঙ্গীত শ্রবণে মনে করিতেন হরিনাথ দেবতা। বিভিন্ন উপলক্ষে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ যখন যে স্থানে গমন করিয়াছেন, তখনই সেই স্থান হরিনাথের বাউলসঙ্গীতের পবিত্র স্রোতে প্লাবিত হইয়া গিয়াছে।’
তার গানে জীবনের অনিত্যতা, সংসারের মায়া-মোহ, পরমপুরুষের সন্ধান-তৃষ্ণা, দেহ-বিচার ও সাধন-প্রক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবেই নানা রূপক-প্রতীকের আড়াল মানতে হয়েছে, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের অলংকারে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হয়েছে তত্ত্বকথাকে। তত্ত্বসংগীতের বিষয়-প্রসঙ্গের ক্লান্তিকর অনুবর্তন, তাত্ত্বিক জটিলতা ও সাধন-পদ্ধতির সাংকেতিক দুরূহতা থেকে যদিও কাঙ্গালের গানও মুক্ত নয়, তবু কখনো-কখনো এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাতে শিল্প-সৌন্দর্য আবিষ্কার করা চলে। আবার তার সৃষ্টি গানগুলোতে আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর ছিল। গান রচনায় তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। স্বলিখিত গানে কাঙ্গাল ভণিতার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। তার রচিত বাউল সংগীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন।
“হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো/পার করো আমারে/তুমি পারের কর্তা জেনে বার্তা/তাই ডাকি তোমারে/আমি আগে এসে/ঘাটে রইলাম বসে /যারা পাছে এলো আগে গেল/আমি রইলাম পড়ে/শুনি কড়ি নাই যার /তারে তুমি কর পার/আমি দীনভিখারি নাইকো কড়ি/দেখো ঝুলি ঝেড়ে/আমার পারের সম্বল/তোমার নামটি কেবল/কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ কেঁদে/অকুল পাথারে সাঁতারে ॥” এই গানটি কাঙ্গাল হরিনাথের অন্যতম সৃষ্টি।
এবার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গানের কথায় আসা যাক- “এই মানবজীবন ভাই/এই আছে আরÑ এই নাই/যেমন পদ্মপত্রে জল টলে সদাই/তেমনি দেখিতে দেখিতে নাই।/আজ গেল আমার/পরে যাবে কেহ/অনিত্য এই মানবদেহ/তবে কেন অহংকারে বল মত্ত সদাই/যদি যেতে হবে জান নিশ্চয়/তবে বৃথা কেন হারাও সময়/বিত্ত অন্তের উপায়/কর এখন সত্য আশ্রয়/সময় যা যাবার, তা গেছে চলে/আর হারাও কেন মায়ায় ভুলে/এখন কাতর হয়ে/ডাক দীন বন্ধো বলে” ॥ এমন অনেক অমর সৃষ্টি আছে কাঙ্গাল হরিনাথের। প্রবন্ধ, গদ্য এবং পদ্য রচনায়ও হরিনাথ মজুমদার যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর
নতুন প্রজন্মের কাছে কাঙ্গাল হরিনাথের স্মৃতিকে তুলে ধরতে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জাদুঘর নির্মাণ করে সরকার। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার গড়াই নদীর তীরবর্তী কু-ুপাড়ায় অবস্থিত এ জাদুঘর। জেলাশহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। লাল ইট আর মোজাইক টাইলসের কারুকাজে নির্মিত একটি ভবন। বাহারি ফুলের বাগানে ঘেরা ভবনটির নাম কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ভেতরে পরিপাটি করে সাজানো কয়েকশ’ বছর আগের ছাপানো পত্রিকা, লেখা কবিতা ও ছবিসহ নানা স্মৃতিচিহ্ন।
প্রবেশের পরই জাদুঘরের আঙিনায় দেখা মিলবে গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথের স্মৃতি-ভাস্কর্য। ভবনের নিচের তলায় রয়েছে ১০০ আসন বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষ। জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার দেয়ালে স্থাপন করা অ্যালবামে শোভা পাচ্ছে কাঙ্গাল হরিনাথ ও তার স্ত্রী, লালন শাহ এবং মীর মশাররফ হোসেনের ছবি। একই সঙ্গে হরিনাথ সম্পাদিত পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’, মুদ্রণযন্ত্রে ব্যবহৃত কাঠের ব্লক ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ ১৬৮টি নিদর্শন এবং ৬৭টি ছবি। এ ছাড়া জাদুঘরের অপর পাশে রয়েছে একটি গ্রন্থাগার। সাড়ে ৪০০ বই রয়েছে গ্রন্থাগারটিতে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কাঙ্গাল হরিনাথের স্মৃতিভরা জাদুঘরটি দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে। জাদুঘর থেকে এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে কাঙ্গাল কুঠির। গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং ইংরেজদের শোষণ-নিপীড়ন হতে তাদের রক্ষার জন্য কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৮৭৩ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ কুমারখালির বাড়ির এমএন প্রেসে মথুরনাথ মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। এই যন্ত্রে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ছাপানো হতো। কাঙ্গালের কুঠিতে এখনো রয়েছে সেই ঐতিহ্যবাহী মথুরনাথ মুদ্রণযন্ত্রটি। সাপ্তাহিক ছুটি উপলক্ষে প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে এবং শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘর। এ ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। জাদুঘরে প্রবেশমূল্য বাংলাদেশিদের জন্য ১০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য ২০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য ৫০০ টাকা।
রচনা সমগ্র
তার মুদ্রিত
গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি। তার
মধ্যে
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-
বিজয় বসন্ত (১৮৫৯)
চারু-চরিত্র (১৮৬৩)
কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬)
কবিকল্প (১৮৭০)
অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩)
চিত্তচপলা (১৮৭৬)
কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী (১২৯৩-১৩০০ বঙ্গাব্দ)
দক্ষযজ্ঞ
বিজয়া
পরমার্থগাথা
মাতৃমহিমা
ব্রহ্মা-বেদ
প্রভাব
কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলগান তার সমকালে সমগ্র বাংলাদেশকে আলোড়িত করতে সমর্থ হয়েছিল। কাঙ্গালের গান জনচিত্তে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। জলধর সেনের সাক্ষ্য জানা যায়, বাংলার অবিস্মরণীয় লোকসংগীত-প্রতিভা পাগলা কানাইয়ের গানের পাশাপাশি কাঙ্গালের গানও স্থান করে নিতে পেরেছিল। এই সাফল্য যে অসামান্য তা বলা বাহুল্য। হরিনাথের গানগুলো অনেক লেখক, সঙ্গীত বোদ্ধাদের মন জয় করে ও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম। আমৃত্যু বঙ্গদেশে শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন তিনি। সাহিত্যকর্মে তার সুযোগ্য শিষ্যগণের মধ্যে- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তী জীবনে যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।
মহাপ্রয়াণ
প্রকৃতপক্ষে বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-চেতনায় কাঙ্গালের মরমি বাউলগান সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে এবং সেইসঙ্গে বলা যায়, কালান্তরেও এই গানের আবেদন নিঃশেষিত হয়নি। হরিনাথের জীবন শুরু হয়েছিল সাহিত্যচর্চা, সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, শিক্ষাপ্রসার ও সমাজহিতব্রতের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। লালন ফকিরের সখ্য-সাহচর্যে এসে তার জীবনে যুক্ত হয় মরমি ভাবসাধনার ধারা এবং সেই সূত্রে বাউলগান রচনার পর্ব। এক সময়ে লালন ও তার পথ এসে একটি মিলনবিন্দুতে মেশে মূলত বাউলগানের অনুষঙ্গে। ১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, “নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো”। মৃত্যু পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।