ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রাণীর সঙ্গে মানুষের বন্ধন

বদরুল আলম চৌধুরী
🕐 ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০

ভালোবাসা, মমতার আজকাল বড়ই অভাব। মানবতা বোধ হারিয়ে ফেলেছেন সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। ধরো, মারো, খাও। নিজের পছন্দের কাজটি করতে গিয়ে কখন যে কার কি ক্ষতি হলো, না হলো সেদিকে দৃষ্টির দরকার নেই। কথার সঙ্গে কাজের বড্ড অমিল। সব মিলে মানবজাতিতে হতাশা বিরাজমান। ঠিক তখনই এ ছবিটি মনে করিয়ে দিয়েছে অতীত কিছু সিনেমা আর ছোট গল্পের কথা। যেখানে প্রাণী-মানুষের কতটা বন্ধন।

 

আপন সন্তানের মতোই জনৈক গৃহস্থের গা-ঘেঁষে শুয়ে আছে গরুর শাবক। এ দৃশ্য হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। এটি যেন সেই ছোটবেলায় পড়া শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্রের গল্পে ছিল মহেশ নামের গরুর সঙ্গে গৃহস্থের মমতার সম্পর্কের কথা।

কাশিপুর গ্রামে বাস করতেন গফুর মিয়া। তার প্রিয় গরুটির নাম ছিল মহেশ। মহেশের খাবার সংগ্রহ আর একখানা ছাউনি করার জন্য জমিদার বাবুর কাছে মাথা নত করেছিলেন গফুর মিয়া। মহেশ যেন তার প্রভু গফুর মিয়ার মনের কথা বুঝতে পারত।

একইভাবে মনে করিয়ে দেয় ইরানি সিনেমা ‘গাভ’-এর গল্প। ইরানের ছোট্ট একটি গ্রাম। চাষি মাশত হাসানের ছেলেপুলে নেই। মনটা ভারী থাকে তাই। গ্রামের ছোট রাস্তার মুখে আজ লোকসমাগম। হাসানের মুখেও আনন্দের খেলা। সবাই ছুটে আসে হাসানের কাছে। সে যে আজ নতুন করে ঢুকেছে গ্রামে। মলিন মুখে হাসির ঝলক। কারণ, সঙ্গে আছে তারই সন্তান।
হাসান যাকে নিয়ে ঘরে ফেরে, সে একটি গাভী। নিঃসন্তান হাসানের গাভটিই এখন সব, ছেলে কিংবা মেয়ে। হাসান ঘরে ঘুমায় না, ঘুমায় গাভীটির সঙ্গে গোয়ালঘরে। গাভী যখন খড় খায়, হাসান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ঠিক যেমনটি বাবা সন্তানের খাবার পানে তাকিয়ে থাকে। হাসান গাভীটিকে আদর করে দেয়, গাভীটির সঙ্গে কথা বলে। ধীরে ধীরে সন্তানের জায়গায় স্থান করে নেয় গাভী। হাসানের স্ত্রী সন্তানের কথা বলে। হাসান দেখিয়ে দেয় গাভীকে, এই মুহূর্তে সেই তাদের একমাত্র সন্তান। হাসানের আচরণে স্ত্রী, গ্রামবাসী অবাক হয়। তাতে সম্পর্কে একটুও চিড় ধরে না হাসান ও গাভীর। একদিন গাভীটি গর্ভধারণ করে। হাসানের খুশি যেন আর ধরে না।

কী এক কাজে হাসান চলে যায় গ্রামের বাইরে। বেশ কদিনের জন্য। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সকালবেলা সবাই দেখে গাভীটি মারা গেছে। চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। হাসান এলে তাকে এ কথা কেমন করে বলবে? অবশেষে বুদ্ধি বের হয়, কবর দেওয়া হবে গাভীটি। হাসানকে বলা হবে, চলে গেছে সে, যেদিকে চোখ যায়।

কাজ শেষে হাসান ফেরে। খাঁ খাঁ করছে গোয়ালঘর। সেখানে নেই হাসানের সন্তান। সবাই পরিকল্পিত সেই মিথ্যা গল্পটি বলে হাসানকে। হাসান মানে না। সে পাগলের মতো হয়ে যায়। ঘুমায় গোয়াল ঘরেই। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। একদিন সবাই দেখে, হাসান খড় খাওয়া শুরু করেছে। হাসান নিজেই যেন হয়ে উঠছে সেই গাভী!

সিনেমাটির পরিচালক দারউইশ মেহেরজুই এই গল্পে যে বিশাল অর্থ এঁকেছেন, তা এই সময়ে এসেও যেন হাজির। জীবের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দিকটি নিয়ে আজও সারা বিশ্বে প্রশ্নের মুখোমুখি।

প্রকৃতি কিংবা প্রাণীর সঙ্গে মানুষের যে মেলবন্ধন মেহেরজুই দেখিয়েছিলেন, তা আজ খুবই দরকার। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মানুষ অবরুদ্ধ করেছে নিজেকেই। আর প্রকৃতি মেলে দিয়েছে তার অপার ডানা। ইতালির লেকগুলোতে দূষণ কমছে। সেখানে আবার চলে এসেছে মাছ। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নেই পর্যটক। ডলফিন শুরু করেছে জলকেলি। মাত্র কদিনের পরিবর্তনে প্রকৃতি মুখ খুলেছে। বলছে, তারা চায় বন্ধুত্ব। আর আমরা দূষণে, বর্জ্যে খামখেয়ালি জীবনাচরণে প্রকৃতিকে করেছি অতিষ্ঠ। বলে রাখা ভালো, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যে চীনে, পৃথিবীর দূষণ কার্যক্রমে তারা বরাবরই প্রথম কাতারে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অবরুদ্ধ আমরা। সময় যেন কাটছে না। আর এ দৃশ্যটি মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মেলবন্ধন, আচরণ।

প্রাণীর সঙ্গে কাল্পনিক এ দৃশ্যকল্প দারউইশ মেহেরজুই এঁকেছিলেন ১৯৬৯ সালে ‘গাভ’ ছবি দিয়ে। তার ঠিক ৩৯ বছর পরে প্রাণী ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্রই বানিয়ে ফেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রকার সং রুল লি। ‘ওল্ড পার্টনার’ নামের ওই ছবিতে ৪০ বছরের একটি বয়স্ক গরুর সঙ্গে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের জীবনযাত্রা বয়ান করা হয়েছে। সং ওই ছবিতে বৃদ্ধ কৃষক চোয়ি উন কিউনের জীবনযাত্রা সমান্তরালভাবে একটি বয়স্ক বলদের সঙ্গে দেখিয়েছেন। দুজন দুটি আলাদা প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব, জীবনের চলার পথে একে অপরের প্রয়োজনীয়তা পরিচালক সং এঁকেছেন কাব্যিক তুলিতে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper