পাঁচ তরুণের ক্যালিগ্রাফিচর্চা
বিবিধ ডেস্ক
🕐 ১:১৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৯, ২০২০
ক্যালিগ্রাফি ইংরেজি শব্দ। যার উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ক্যালি (সুন্দর) ও গ্রাফিয়া (লেখা) থেকে। অর্থ : সুন্দর লেখা। এই সুন্দর লেখা যে কোনো ভাষায়ই হতে পারে। আরবি, বাংলা, ইংরেজি, জাপানিসহ বিভিন্ন ভাষার হতে পারে। গত এক দশকে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। যার নেতৃত্বে রয়েছে একদল উদ্যমী তরুণ। প্রতিভাবান শীর্ষ পাঁচ তরুণের ক্যালিগ্রাফিতে সফলতার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রতিশ্রুতিশীল ক্যালিগ্রাফার জামিল আহমেদ
তিনি আর্ট-ক্রাফটিং করতেন। বইপত্রে নানা কথা বিভিন্ন ডিজাইনে লেখা থাকত। তাও কপি করতেন। অনেকের নাম সুন্দর ডিজাইন করে লিখতে পারতেন। এভাবে এই লেখাগুলো যে ক্যালিগ্রাফি হতে পারে তখন তিনি জানতেনই না। ক্যালিগ্রাফির বর্ণাঢ্য ইতিহাস আছে, তাও কেউ তাকে তখন বলেনি। অজানা একটা বিষয়ে তিনি দক্ষ হয়ে উঠলেন। এখন তিনি সফল একজন ক্যালিগ্রাফার। দেশ ও দেশের বাইরে তার খ্যাতি। সফল প্রতিশ্রুতিশীল এই ক্যালিগ্রফারের নাম জামিল আহমদ। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ভাদেশ্বর গ্রামে থাকেন।
তিন বোন আর দুই ভাই মিলে তার পরিবার। আর্টকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন ২০০৮ সাল থেকে। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রতিষ্ঠান আছে S.M Art’s and craft’s নামে। এই নামেই আছে ফেসবুক পেজ। সেখানে কাজের অর্ডার দেওয়া যায়। দেখা যায় কাজের ধরনও। জলরঙ, এক্রিলিক, তেলরঙ। ছবি আঁকার এই তিন মাধ্যমেই তিনি সমান দক্ষ। তবে এক্রিলিক কালার দিয়ে কাজ করতে তার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ।
এ পর্যন্ত তিনি ৪টি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। দেশের বাইরে (ভারত) একটি এবং দেশে তিনটি।
এছাড়া জাতীয় পর্যায়ের ছোট-বড় সব মিলিয়ে আরও সাতটি প্রদর্শনীতে তার উপস্থিতি ছিল। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারও জুটেছে অনেক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ার বিখ্যাত আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে বেস্ট আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ক্যালিগ্রাফি কম্পিটিশন এন্ড এক্সিবিশনে প্রথম পুরস্কার, Alluring Artwork আয়োজিত International winter art festival ২০১৯-এ মিক্সড মিডিয়া ক্যালিগ্রাফিতে বেস্ট আওয়ার্ড। তার আয়াতুল কুরসি ক্যালিগ্রাফি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যদিকে রিকশা পেইন্টিংও অসংখ্য মানুষ পছন্দ করেছে। তার ক্যালিগ্রাফি দেখে ভারতের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ভার্সিটির কো-অর্ডিনেটর ড. এফ এস শিরানী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় ক্যালিগ্রাফারদের ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির কাজগুলো দেখে সত্যিই আমি অবাক হতাম। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু তোমার এই ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং দেখে মনের মধ্যে শান্তি অনুভূত হচ্ছে। মন চাইছে, প্রত্যেকটা কাজ নিয়ে আমার বাসার প্রতিটা দেয়াল সজ্জিত করে দিই। শুরুর দিকে নিজে নিজে ক্যালিগ্রাফি চর্চা করেছেন বটে। তবে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদের ওয়ার্কশপ তার চোখ খুলে দেয়। তিনি সিলেট থেকে এসে ওয়ার্কশপে অংশ নেন। জামিল মনে করেন, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বিকাশে এম এম আর্ট ফাউন্ডেশন ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ক্যালিগ্রাফিতে সফলতার নেপথ্যে পারিবারিক সাপোর্ট বড় ব্যাপার। জামিল বলেন, আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে, পরিবার সঙ্গে আছে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে তুলে ধরাই তরুণ উদ্যমী ক্যালিগ্রাফার জামিলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
উসামা শব্দে ছবি আঁকেন
শখের কাজের প্রতি যদি ভালোবাসা, ভালোলাগা, যত্ন থাকে তাহলে সফলতা পেতে দেরি হয় না। শখ আর কৌতূহলের বশে শুরু করেছিলেন ক্যালিগ্রাফি। কিন্তু অল্প সময়ে ক্যালিগ্রাফিতে সকলের নজর কেড়েছেন তিনি। একাধিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে তার ক্যালিগ্রাফি, দেশের বাইরে প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছা, দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফারদের প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। নন্দিত এই ক্যালিগ্রাফারের নাম উসামা হক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে মাস্টার্স পড়ছেন। পরিবারে তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। থাকেন গাজীপুরে। ছোটবেলা থেকেই তার আর্টের প্রতি ঝোঁক। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েন। অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে নেন আর্ট। বড় ভাই আহমদ রেজা ফারুকী তাকে ক্যালিগ্রাফি শেখান। তার হাতেই ক্যালিগ্রাফির হাতেখড়ি হয় উসামা হকের। উসামা বলেন, আহমদ রেজা ফারুকী ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা শুরু করি। অক্ষরের শেপ, শব্দ তৈরি এবং পরবর্তীকালে বাক্য কম্পোজিশন, রঙয়ের ব্যবহার তার কাছ থেকেই শিখেছি। এরপর নিসার উদ্দিন জামিল, আব্দুর রহিম, বাংলাদেশের খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদ স্যার ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। মাহবুব মুর্শিদ ওয়ার্কশপের আয়োজন করেন। সে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয় উসামার। ওয়ার্কশপ যেন উসামার চোখ খুলে দেয়। তিনি বলেন, ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়ার পর আমার কাজে পরিবর্তন আসে! ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং নতুন করে বুঝতে পারি এবং শুরু হয় আমার ক্যালিগ্রাফি নিয়ে স্বপ্ন দেখা। ক্যালিগ্রাফিতে সাধারণত কী লেখেন? ক্রেতা যা বলে দেয় তাই নাকি পবিত্র কোরআনের আয়াত? উসামা বলেন, ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ে যে কোনো বাক্যই লিখি।
তবে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো ক্যালিগ্রাফি হিসেবে অসাধারণ হয় তাই সেগুলো বেশি করা হয়। এছাড়াও বাংলা ক্যালিগ্রাফি করে থাকি। অনেকে বিয়েতে নবদম্পতির নাম ক্যালিগ্রাফি উপহার হিসেবে দিতে চায়, সেগুলোও করে দিই। ক্যালিগ্রাফির কাজ করছেন তিনি প্রায় ১৪/১৫ বছর। তবে পেশা হিসেবে নিয়েছেন বছর দুয়েক হবে। তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইন, বিজনেস কার্ডের কাজও করে থাকেন। আরবি, বাংলা এবং ইংরেজি এ ভাষাগুলোতে ক্যালিগ্রাফি করেন। দোহাতে অনুষ্ঠিত DOHA OIC YOUTH CAPITAL INNOVATION AWARD প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত টিকে ছিল উসামার ক্যালিগ্রাফি। তিনি জানান, নিউইয়র্কে এক মসজিদের জন্য তার চারটি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং নেওয়া হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের চলতি বছরের ক্যালেন্ডার উসামার ক্যালিগ্রাফি দিয়ে করা হয়েছে।
উসামা বলেন, ক্যালিগ্রাফির কাজ বিদেশে রপ্তানি করার অসীম সুযোগ রয়েছে। ভালো কোনো মাধ্যম পেলে বিদেশে ব্যাপক পরিমাণে ক্যালিগ্রাফির কাজ রপ্তানি করা সম্ভব। ক্যালিগ্রাফিতে বর্তমানে বিশ্বে ভালো করছে তুরস্ক, ইরান, মিশর। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আমাদের কাজ এখন চোখে পড়ার মতো! আমাদের দেশে ক্যালিগ্রাফি এখন পেইন্টিং-এর আদলে চর্চা করা হচ্ছে যার জন্য অন্যান্য দেশের শিল্পীরা আমাদের কাজ ফলো করছে। এক্রিলিক এবং ওয়াটার কালার এ দুই মাধ্যমেই বেশি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করেন তিনি। সাইজ, কাজ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়।
আফসানা মিমির পেশা ক্যালিগ্রাফি
ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে রুম সাজানো হবে। সিনিয়ররা তাকে ক্যালিগ্রাফি করতে বললেন। কিছুই তো তেমন জানা নেই। গুগল ঘেটে যে ক্যালিগ্রাফি তিনি করলেন। তাতেই একদম বাজিমাত। শিক্ষক, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই ভূয়সী প্রশংসা করল। উৎসাহ দিল। মেয়েটি যেন এতদিন এরই অপেক্ষায় ছিল। এটা ২০১৫ সালের ঘটনা। এরপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ক্যালিগ্রাফি করেছেন। ক্যালিগ্রাফি জগতে নিজের জায়গাটা পোক্ত করে নিয়েছেন।
ক্যালিগ্রাফি, ছবি আঁকা এখন তার পেশা। সফল উদ্যমী এই তরুণীর নাম আফসানা মিমি। তিনি সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। পরিবার নিয়ে গাজীপুরে বসবাস করেন। আঁকাআঁকির নেশাটা আফসানার ছোটকাল থেকেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। নিজ থেকেই শেখা। বটবৃক্ষের মতো পাশে পেয়েছেন মাহবুব মুর্শিদকে।
আফসানা বলেন, মাহবুব মুর্শিদ স্যার আমার ক্যালিগ্রাফি দেখেন। উৎসাহ দেন। স্যার আমার ক্যালিগ্রাফি দেখে বলেছেন, এত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন গোছানো কাজ, দেখে চোখটা শীতল হয়ে যায়, মনটা ভরে যায়।
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাহবুব মুর্শিদ। তার হাতে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফার গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। এম এম আর্ট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দেন।
আরবি, বাংলা দুই মাধ্যমেই আফসানা ক্যালিগ্রাফি করেন। ল্যান্ডস্কেপও আঁকেন। তিন বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ক্যালিগ্রাফি করেন। এ পর্যন্ত আফসানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে মোট ৭টি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- তুর্কি বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি এক্সিবিশন, ওআইসি আয়োজিত ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী, পেন্সিল ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রদর্শনী, স্বরলিপি দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রদর্শনী, ফোকাস বাংলাদেশ আয়োজিত 4th Tune of Art International art Festival, Alluring Art আয়োজিত International Winter Art Exhibition, Obscure Artist of Bangladesh আয়োজিত প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীতেই আফসানার অনেক ক্যালিগ্রাফি বিক্রি হয়ে গেছে। অবসকিউর আর্ট ও বাংলাদেশের আয়োজিত প্রদর্শনী থেকে দুটি ক্যালিগ্রাফি বিদেশিরা কিনে নিয়ে যান। ক্যালিগ্রাফি ক্রয় করার পদ্ধতি সম্পর্কে আফসানা বলেন, মূল্য নির্ধারণ করি সাইজ, লেখা এবং ডিজাইন কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করে।
কেউ নিতে আগ্রহী হলে অর্ধেক টাকা পরিশোধ করতে হয়, বাকিটা ক্যালিগ্রাফি পৌঁছানোর পর। ঢাকার মধ্যে হলে আমার ভাই পৌঁছে দেন। ফেসবুকে আফসানার পেজের নাম Painting Brush by Afsana. ২০১৭ সাল থেকে ক্যানভাসে পেইন্টিং শুরু করেন আফসানা। আফসানার আয়াতুল কুরসি ক্যালিগ্রাফি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আফসানা জানান, ক্যালিগ্রাফিটি তাকে মোট চারবার করতে হয়েছে। চতুর্থবারেরটা প্রদর্শনী থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। তার করা সুরা তওবার শেষ দুই আয়াত, সুরা ফাতিহা আর ৪ ক্বুলের ক্যালিগ্রাফি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। একটি সংস্থার ক্যালেন্ডারে ও আফসানার ক্যালিগ্রাফি স্থান পেয়েছে। ক্যালিগ্রাফির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা খুব ভালো। আগে ক্যালিগ্রাফির প্রতি মানুষ কিছুটা উদাসীন থাকলেও বর্তমানে ক্যালিগ্রাফি অনেক প্রশংসনীয় হচ্ছে। অনেকেই ক্যালিগ্রাফিকে পেশা হিসাবে নিচ্ছে বলে আফসানা জানান।
ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে যায়। এতেই আফসানা খুশি। নিজের কাজটা আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। কাজের মাধ্যমে টিকে থাকতে চান। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চান। এসবই উদ্যমী তরুণী আফসানা মিমির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
তামীমার ক্যালিগ্রাফি হাতে হাতে
মাদ্রাসায় পড়তেন তখন। সিনিয়র ছাত্রীদের কাজ দেখতেন। ভাবতেন- ইশ, এমন ক্যালিগ্রাফি যদি করতে পারতাম! ২০১৩ সালের ঘটনা। প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেন। ভয়ে কাঁপা হাতে ক্যালিগ্রাফি জমা দেন। মা তখন পাশে ছিলেন। সাহস জোগান তিনি। সবাইকে অবাক করে ওই প্রতিযোগিতায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের জন্ম তখন থেকেই। এরপর মাদ্রাসায় যত ক্যালিগ্রাফির কাজ হত, সবটাতেই থাকতেন। ক্যালিগ্রাফিতে একের পর এক সফলতা অর্জন করেছেন। সফল মানুষটির নাম সানজিদা হুসাইন তামীমা। থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুর। গ্রামের বাড়ি দামপাড়া, নিকলী, কিশোরগঞ্জে। কওমী এবং আলিয়া মাদ্রাসার দুই লাইনে তার পড়াশোনা। পরিবারে বাবা-মা ও তিন বোন এক ভাই। এ পর্যন্ত তিনি ৫০০ থেকে শুরু করে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ক্যানভাস পর্যন্ত করেছেন। তবে সাধারণত ছোট-বড় নাম ক্যালিগ্রাফিগুলো করতে ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত নেন। ফেসবুকে তার পেইজের নাম Hurufiyah। তার আইডি SH Tamima-তেও অর্ডার দেওয়া যায়। ইন্টারনেটে, ইউটিউবে পরিচিতদের কাজ দেখে শিখতেন। তবে প্রচ-ভাবে একজন শিক্ষকের অভাব বোধ করতেন। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তার পরিচয় হয় খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদের সঙ্গে। এরপর মাহবুব মুর্শিদের ৬টি কর্মশালায় অংশ নেন। ক্যালিগ্রাফির মূল বিষয়গুলো হাতে-কলমে শিখে নেন।
তামীমা বলেন, মাহবুব মুর্শিদ স্যারের হাতে আমার ক্যালিগ্রাফির হাতেখড়ি। স্যার প্রচুর উৎসাহ দিলেন। ২০১৮ সালের মার্চে স্যারের প্রথম ক্যালিগ্রাফি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। যেটা আমার জন্য ছিল ক্যালিগ্রাফির টার্নিং পয়েন্ট। সেখান থেকেই হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফির সব কিছু শেখা। ক্যালিগ্রাফিতে তিনি কোরআনের আয়াত, হাদিস, দোয়া, আরবি কবিতা, প্রবাদ ইত্যাদি লিখে থাকেন। আবার একক নাম, যুগল নামও ক্যালিগ্রাফি করে দেন।
ক্যালিগ্রাফির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে এখনো তেমনভাবে বাণিজ্যের প্রচলন হয়ে ওঠেনি। যেমনটা আরব দেশগুলোতে রয়েছে। অন্যান্য দেশে ক্যালিগ্রাফি বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম। ইউরোপের দেশগুলোতেও চাহিদা রয়েছে। আমাদের ক্যালিগ্রাফিগুলো বেশ ভালো দামে অন্য দেশে বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। এমনটাই মনে করেন সানজিদা হুসাইন তামীমা। এ পর্যন্ত তিনি ৭টি প্রদর্শনী ও একটি মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একটিতে জাতীয় পুরস্কার ও ফোকাস বাংলাদেশ আয়োজিত প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তামীমার কাজ সম্পর্কে মাহবুব মুর্শিদ বলেন, ‘সত্যিই আজ তামীমা লৌহকপাট ভেঙে এক অসাধারণ কর্মযজ্ঞ ঘটিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এত সাহসী পেইন্টিং খুব কম জনই দেখাতে পেরেছে। ‘বাংলার মুখ’ তার অন্যতম জনপ্রিয় কাজ। এছাড়া তার কাপল নাম ক্যালিগ্রাফিগুলো তুলনামূলক প্রসিদ্ধ। এ পর্যন্ত ২০টির বেশি যুগল নাম ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। আরও নতুন কিছু যুগল নাম ক্যালিগ্রাফির অর্ডার রয়েছে বলে তিনি জানান। ক্যানভাস ছাড়াও ছাতা, টুপি, ক্যাপ, ফোন কভার, বুকমার্ক, ইসলামিক কার্ড ইত্যাদিতে রঙের কাজ ও ক্যালিগ্রাফি করেন তিনি। ভবিষ্যতে ছাতায় আর্ট ও ইসলামিক কার্ড নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান।
তামীমার কাজ বিদেশেও গিয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে। তিনি জানান- ৩টি ব্রুনাই, ৩টি মালয়েশিয়াতে গিয়েছে। ব্রুনাইয়ের দুজন এম্বাসেডর ও একজন কাউন্সিলর আর মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রী ও একজন এডভোকেট ছিলেন তার ক্লায়েন্ট। তামীমার মতে, ক্যালিগ্রাফি বিদেশে রপ্তানির অনেক সুযোগ রয়েছে।
মুনতাসিরের ক্যালিগ্রাফিতে মুগ্ধতা
ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি তার ঝোঁক। অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখা। ক্যালেন্ডারে ক্যালিগ্রাফি তাকে খুব আকর্ষণ করত। টুকটাক মানুষের নাম লিখে দিতেন। সবাই তার লেখার ভূয়সী প্রশংসা করত। ২০১৭ সালের কথা। তিনি কালিগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবলেন। কারণ তত দিনে তার ক্যালিগ্রাফির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে অনেকখানি। তাছাড়া এরই মধ্যে বাবা ও বড় বোনকে হারান তিনি। পরিবারের দায়িত্ব তখন তার কাঁধে চলে আসে। এখন তিনি পরিচিত জনপ্রিয় ক্যালিগ্র্যাফিক শিল্পী। তরুণ এই শিল্পীর নাম মুনতাসির হক মুন। কোরআনে হাফেজ। পড়াশোনা করছেন অর্থনীতি বিষয়ে। বাবা নেই। তিন ভাই আর দুই বোন।
ক্যালিগ্রাফির বিষয়ে মুনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তবুও তিনি এত ভালো করলেন কীভাবে? মুন বলেন, ক্যালিগ্রাফি শেখা বা চর্চা সম্পূর্ণ নিজ থেকেই বলা যায়। দিনের দিন আমি লেগে থেকেছি। কীভাবে লেখাটা আরও উন্নত করা যায়। সেটা ভেবেছি। শুরুতে মুন ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদের একটি ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহ ৫টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। এসব প্রদর্শনীতে তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন বলে জানান। মুনের মতে, ক্যালিগ্রাফিতে অযুত সম্ভাবনা রয়েছে। দেশ এই শিল্প থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যালিগ্রাফি বিদেশে রপ্তানি করারও সুযোগ রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে এগুলোর ভালো দাম পাওয়া যায়। তাছাড়া আমার নিজস্ব কিছু কাজ ও অনেকেই দেশের বাইরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান। ক্যালিগ্রাফিতে আরব বা ইসলামি চিন্তাধারার দেশগুলোই এগিয়ে। সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশ এগিয়ে আছে। ক্যালিগ্রাফিতে সাধারণত কোরআনের আয়াত বেশি লেখা হয়। অনেকে অবশ্য নামও লেখান বলে মুন জানান। মুনের একটি ফেসবুক পেজ আছে নাম গড়ড়হ ঈধষষরমৎধঢ়যু! আঁকার ক্ষেত্রে কম্পোজিশন কেমন হবে বা ডিজাইনটা কেমন হবে তার একটা গ্রাফ আগেই করে নেন তিনি। অনেক সময় ব্যাকগ্রাউন্ড বা কালারের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টের পছন্দ বিবেচনায় নিতে হয়। ক্যালিগ্রাফি একটি আর্ট বা শিল্প। যেখানে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে হয়। সঙ্গে কালারিং ডিজাইন বা কম্পোজিশনের ব্যাপারগুলো তো আছেই। সার্বিক পরিশ্রমের বিবেচনায় বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির মূল্য খুব একটা ভালো নয়। মুন ৮০০ থেকে শুরু করে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত তার কাজের পারিশ্রমিক নিয়েছেন বলে জানান। তার সঙ্গে দুজন সহকারী কাজ করে। কোরআনের আয়াত, আয়াতুল কুরসি মানুষ বেশি ক্যালিগ্রাফি করে বলে মুন জানান।