Warning: mysql_fetch_array() expects parameter 1 to be resource, boolean given in /home/www/kholakagojbd.com/index_get_new.php on line 158

ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গানের অনিবার্য অনুষঙ্গ বাদ্যযন্ত্র

মৃত্তিকা দেবনাথ
🕐 ১২:১২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১২, ২০২০

সংগীতের প্রধান উপাদান সুর হলেও তাল অনিবার্য। সেই তালেরও সৃষ্টি হয়েছে হাতের তালি বা তুড়ি থেকে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়া কোনো বাদ্যই বাজানো সম্ভব নয়। প্রাচীনকাল থেকে শুধু সংগীতই নয়, পূজা-পার্বণ, ক্রীড়া-উৎসব, ব্যবসা, শিক্ষা, যোগাযোগ, প্রজ্ঞাপন সর্বক্ষেত্রেই বাদ্যের অপরিহার্যতা লক্ষ করা যায়। সংগীত পরিবেশনায় বাদ্যযন্ত্র গানকে আকর্ষণীয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাদ্যযন্ত্র কেবল একটি গানকে সৌন্দর্যম-িত করে না, সাংগীতিক পরিবেশে আরও মোহময়তা সৃষ্টি করে। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে লিখেছেন মৃত্তিকা দেবনাথ

হারানো সুরের খোঁজে...

বাংলার লোকবাদ্য বাজানো হয় বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে। কবিগান, পালাগান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভা-ারি, সাঁওতালি, বাউল, ঝুমুর, ভাদু, টুসু ইত্যাদি গানে আবার দুর্গাপূজা, রাস উৎসব, লীলাকীর্তন, দোতরাগান, গম্ভীরা, কুষাণ, যাত্রাগান, বিচারগান, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, মেয়েলিগীত, বিবাহযাত্রা, শোভাযাত্রা, নাটগীত, মনসার ভাসান ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বাংলার বাদ্য বাজানো হয়। এদেশে কত ধরনের বাদ্য ছিল তা হিসাব করে বলা যাবে না। অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনো যা আছে তাও দুই শতের কম হবে না। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাগীতিতে যে সকল বাদ্যযন্ত্রের নাম জানা যায় তা হলÑ পটহ, একতারা, ঢোল, হেরুক বীণা, ডমরু, বাঁশি, মাদল, নেউর বা নূপুর, কর-, কশালা, দুন্দুভি, ডমরুলি ইত্যাদি।

মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে সবচেয়ে বেশি লোকবাদ্যের নাম জানা যায়। দামামা, দগড়, রগড়, ঢাক, ঢোল, খোল, ডম্ফ, বীণা, কাঁশি, বাঁশি, ডুগডুগি, করতাল, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, ভেউরি, ঝাঁঝরি, কাড়া, জয়ঢাক, শঙ্খ, তাসা, ঢেমচা, খেমচা, পাখোয়াজ, মাদল, রামসিঙ্গা, জগঝম্প, শানাই, মুহরি, রাক্ষসী ঢাক, দুন্দুভি, খঞ্জনি, খমক, তবল, তুরি, ভেরি, রণসিঙ্গা, টিকারা, টঙ্কার, মোচঙ্গ, কাহাল, পটহ, বরগা, মন্দিরা, মুহরি, মুরলি বা বংশি, নূপুর, ভেউর, করনাল, পিনাক, সাহিনী, স্বরম-ল, দোতারা, সেতারা, কাংশ্য, সানি, দড়মসা, ভেউর, বিষাণ, মরুজ, পাঢ়া, করড়া, টিকারা, ধাঙসা, কাকল, সারিন্দা, খটক, কিঙ্কিনি-কঙ্কণ, ভরঙ্গ, চুড়ি, তম্বুরা, কপিনাশ, ঘুঙুর, নৌবত, সিংহা, বিপঞ্চা, ঝাম, বর্গেল প্রভৃতি। পরবর্তী সময়ে পুঁথি সাহিত্য, বিভিন্ন গল্পগাঁথায় উপরোক্ত বাদ্যগুলোর নাম জানা যায়। দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার সংগৃহীত ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি ইত্যাদি গল্পকথায় প্রায় ২৬টি লোকবাদ্যের প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে জানা যায়। গ্রামীণ ধাঁধা ও বচনের মধ্যেও বিভিন্ন বাদ্যের নাম ও চরিত্র সম্পর্কে জানা যায়।

শৌখিন মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কিছু বাদ্যযন্ত্র থাকলেও এগুলোর দৈনন্দিন ব্যবহার আর দেখা যায় না। সময়ের স্রোতে এ রকম আরও অসংখ্য লোক বাদ্যযন্ত্র হারিয়ে গেছে, হয়ত ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে একতারা, দোতারার মতোও অতি পরিচিত বাদ্যযন্ত্র। বাদ্যযন্ত্রের এ হারিয়ে যাওয়ার মানে শুধু এই নয়, কিছু যন্ত্র হারিয়ে গেল। এসবের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে লোক-ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ, ইতিহাস, সংস্কৃতি। সুতরাং পরম্পরা ধরে দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে চলতে চাইলে লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এসব অনুষঙ্গের সংরক্ষণ ও প্রসার দুটোই সমান জরুরি। প্রায় হারিয়ে যাওয়া এমন কিছু লোক বাদ্যযন্ত্রের পরিচিতি নিয়ে আজকের লেখা।

খমক

খমক বা আনন্দলহরী বাউল গান, জারি, ভাটিয়ালি গানের অন্যতম বাদ্যযন্ত্র। ভক্তিমূলক গানেও এ যন্ত্র বাজানো হয়। কাঠ দিয়ে ঢোলকের আদলে তৈরি বাদ্যযন্ত্রটির একপাশ খোলা। আর খোলা অংশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সুতার সাহায্যেই মূলত বাজানো হয়। খমক একতারার প্রায় কাছাকাছি একতার বিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু খমকের সঙ্গে একতারার পার্থক্য হচ্ছে, খমকের মাথার দিকে একতারার মতো বাঁশের ব্যবহার নেই। খমকের তার একহাতে ধরা থাকে এবং বিপরীত হাতে বাদক বাজাতে থাকে। খমক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশে লোকসংগীতে ব্যাপক প্রচলিত। শূন্যপুরাণ ও মঙ্গল কাব্যেও নাচ-গানের বাদ্য হিসেবে ঐতিহ্যবাহী খমকের উল্লেখ রয়েছে।

আড় বাঁশি

মধ্যযুগের অমর কাব্য শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে আড় বাঁশি। আড় বাঁশি আমাদের লোক বাদ্যযন্ত্র। বাঁশি ফুৎকার (ফুঁ) দিয়ে বাজানো যায়। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করণের নাম ফ্লুট (ভষঁঃব)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে স্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরি করে থাকেন। মনহরানো আড় বাঁশির গায়ে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও করতে দেখা যায়) থাকে। বাঁশের তৈরি বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ’টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়।


ডুগি

ডুগি এক ধরনের ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র যা, কেটলির আকৃতির মতো। এটি আঙুল ও হাতের তালু দিয়ে বাজাতে হয়। ডুগি বাংলাদেশি বাউলরা তাদের গানে ব্যবহার করে। ভারতের উত্তর প্রদেশে ডুগি আবার পাঞ্জাবে ডুক্কার বলে পরিচিত যা লোকগানের মূল বাদ্যযন্ত্র। সানাইয়ের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে একজন ডুগি বাদক মূল তাল ঠিক করে, কিন্তু বর্তমান সময়ে, একজন তবলা বাদক এই কাজটি করে থাকে। ডুগি দেখতে অনেকটা তবলার মতোই, কিন্তু আকৃতিতে ছোট।

সানাই

কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না, বিয়ের উৎসবে সানাই বাজবে না! সানাই রাগসঙ্গীত যন্ত্র হিসেবে পরিচিত হলেও যন্ত্রটি লোকসঙ্গীতেও ব্যবহার করা হয়। সামাজিক নানা উৎসবেও এ যন্ত্রের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। সানাইয়ের মূল কাঠামো মূলত কাঠের তৈরি। এটি দেখতে নলের মতো। এর এক প্রান্তে দুটি রিডের সেট থাকে। রিড দুটি সানাইয়ের মূল অংশের যে প্রান্তে থাকে, সেদিক দিয়েই মূলত শব্দ তৈরি হয়। যন্ত্রটির গায়ে সাতটি স্বর তোলার উপযোগী ফুটো থাকে। বাদ্যযন্ত্রটির ওপরের দিক চিকন এবং নিচের অংশ চওড়া। অনেকটা ধুতরা ফুলের মতো।


সারিন্দা

প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোক বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সারিন্দা অন্যতম। সাধারণত মুর্শিদি ও কেচ্ছা গানের অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে এটি বাজানো হত। আজ মুর্শিদিও নেই, সারিন্দাও নেই। দেড় ফুট লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি যন্ত্রটিতে চামড়ার তিনটি তার যুক্ত থাকে। সারিন্দার মাথা ময়ূর কিংবা অন্যান্য পশুপাখির মাথার মতো। যেখানে তিনটি কাঠের বলয় রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় কান। চামড়ার তারগুলো মূলত এ কান থেকে সারিন্দার শেষ প্রান্তজুড়ে আংটা দিয়ে আটকানো থাকে। এ কান ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো সুর নিয়ন্ত্রণ করা হত। সারিন্দার ব্যবহার আজকাল দেখা যায় না বললেই চলে।

একতারা

আমাদের লোকসংস্কৃতির স্বকীয়তা আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে বাদ্যযন্ত্রটি আদি ও অকৃত্রিমভাবে বহমান রয়েছে তার নাম একতারা। এক তারবিশিষ্ট বলে এটিকে একতারা বলা হয়। মাত্র একটি তারের তৈরি বাদ্যযন্ত্রটি দিয়ে বাউল সাধকরা সুরের যে বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। একতারার বাদন ভঙ্গি আর সুরের মূর্ছনায় আজো খুঁজে পাওয়া যায় মাটির ঘ্রাণ। এখনও বাউল ও নগর বাউলদের কাছে শুনতে পাওয়া যায় একতারার বোল। ধারণা করা হয় প্রায় এক হাজার বছর ধরে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। একতারা আমাদের লোক বাদ্যযন্ত্র, একতারা তৈরির উপকরণের দিকে তাকালে সে কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। অনেক বাউল শিল্পী মনে করেন, মরমি সাধক লালন শাহের কালেই একতারার জন্ম।

মৃদঙ্গ

লোকগানের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র মৃদঙ্গ। যন্ত্রটি মাটির তৈরি বলেই এর নাম মৃদঙ্গ। বাদ্যযন্ত্রটি দেখতে অনেকটা কলার মোচার মতো। যার উভয় পাশেই চামড়ার ছাউনি। আর ছাউনির মধ্যখানে লাগানো হয় গাবের গাপ্পি। মৃদঙ্গের একটি মুখ (ডান) ছোট, অন্যটি (বাম) বড় হয়ে থাকে। ফিতার সাহায্যে গলায় ঝুলিয়ে কিংবা মাটিতে রেখে মৃদঙ্গ বাজানো হয়। নানান ধরনের লোকগানের সঙ্গে ভক্তিমূলক গান, কীর্তন গাইতে বাংলার গ্রামাঞ্চলে মৃদঙ্গের প্রচলন ছিল বেশি। মাটির তৈরি যন্ত্রটির ব্যবহারও ধীরে ধীরে কমছে।

দোতারা

দোতারা আমাদের লোক বাদ্যযন্ত্র। এটি বাংলা লোকগীতির সঙ্গে বহুল ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র। দোতারার অন্য নাম স্বরাজ। দুটি তারের সাহায্যেই এতে এক সপ্তকের সকল সুর বাজানো যায় বলে একে দোতারা বলা হয়। তবে কোনো কোনো গুণী ওস্তাদ এতে পছন্দমতো চারটি বা পাঁচটি তার লাগিয়ে থাকেন। যেমন বাউল শাহ আবদুল করিম চারটি এবং ওস্তাদ পাগলা বাবু শাহজাদপুরী তার দোতারায় পাঁচটি তার ব্যবহার করে থাকেন। তবে আমার ব্যবহৃত দোতারা আট তার বিশিষ্ট। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় দোতারার বেশি ব্যবহার দেখা যায়। ধারণা করা হয়, ১৫ শতকের সময় থেকেই বাংলার বাউল ফকিররা তাদের গানের সঙ্গে দোতারা ব্যবহার করে আসছেন। দোতারার অগ্রভাগে কাঠখোদাই ভাস্কর্যে ময়ূর, টিয়াপাখি প্রভৃতি থাকে।

খঞ্জরি

কদিন আগেও বুঝি খঞ্জরির ঝনঝন শব্দ কানে ভাসত। লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্যের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে খঞ্জরির ব্যবহার বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল। খঞ্জরি ‘ডফ’ নামেও পরিচিত। নিম বা কাঁঠাল কাঠের পাতলা চাকতির মতো যন্ত্রটির একটি দিক চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তারপর চাকতির গা-জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে অনেকগুলো ধাতব পাত লাগানো থাকে। ধাতব পাতগুলোর জন্যই ঝনঝন শব্দ হয়। চামড়ার ওপর আঙুলের টোকা দিয়ে কখনোবা তালুর আঘাতে তাল সৃষ্টি করা হয়।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper